ভারত-বাংলাদেশের বার্নিং ইস্যু বলতে আমরা যা বুঝি, তা হল,সীমান্তে হত্যাকাণ্ড আর অভিন্ন নদীর পানি বন্টন ইস্যু। কিন্ত বহুদিন ধরেই বৈঠকের পরে বৈঠক হলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো সমাধান হয়নি। ভারত কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারেনা। যারা সীমান্তে ফেলানী হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তাদের জন্য ঘৃনা ছাড়া আর কি থাকতে পারে! অথচ সবকিছু দেখেও না দেখার ভাণ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অতিরিক্ত ভারত প্রীতি কিংবা ভারতভীতি যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
কেন এখনও তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না? বস্তুত, ২০১৪-১৫ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুক্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে নতুন অজুহাত দিতে শুরু করেন। তিস্তাতে নাকি ভাগাভাগি করার মতো পানিই নেই–তিস্তা পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এমনকি, তিস্তার বদলে ওই অঞ্চলের অন্য সব নদীর পানি ভাগ করার প্রস্তাবও তিনি ভাসিয়ে দেন ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময়। তিনি যা করেছেন তা ছিলো কালক্ষেপণের কৌশলমাত্র।
২০১৭ সালের আগস্টে যখন মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢলে বাংলাদেশ নতুন করে নাস্তানাবুদ, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক বিবৃতিতে কিন্তু এই ট্র্যাজেডির জন্য প্রকারান্তরে দোষারোপ করা হয়েছিল সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী আরসা-কেই। রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি পুরো অঞ্চলের সমস্যা হলেও এবং ভারত সেটাকে পাশ কাটাতে চেয়েছে।
১২ জুলাই, ২০১৯, একজন ভারতীয় জেলে মাছ ধরতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবে ৭ দিন সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের প্রান্তে চলে আসে। বাংলাদেশের জাহাজ, এমভি জাওয়াদের নাবিকরা সেই জেলেকে উদ্ধার করে। আর এটাতো অতীত ইতিহাস থেকে সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশের কোন নাগরিক সাগরে ভাসতে ভাসতে ভারতীয় প্রান্তে গেলে তার ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটতে পারে!
একটু ভেবে দেখলেই আমরা দেখব গত দশ বছরে সীমান্তে ২৩৮ জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। আমাদের সরকার ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেভাবে আত্নার, রাখীবন্ধনের ও স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বলে, সেখানে ২০২০ সালে এসে যেখানে একজনকেও হত্যার শিকার হওয়ার কথা না, সেখানে সর্বোচ্চ ৪৫ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
গত ৩ জানুয়ারি, ২০২১, বাংলাদেশের বিজিবি বৌমারী সীমান্তে ১ জন ভারতীয় গরু চোরাকারবারিকে আটক করে। বিজিবি কি চাইলে আটক না করে গুলি করে হত্যা করতে পারতো না? কিন্তু, বিজিবি সেটি না করে মহত্ত্ব ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সহযোগিতা করে যেভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, ৭১ এর পরে সীমান্ত হত্যা, স্থল ও জল সীমানা নিয়ে মনোমালিন্য, তিস্তা ও পানি চুক্তি নিয়ে তালবাহানা, পেঁয়াজ নিয়ে সংকট সৃষ্টি, সর্বক্ষেত্রে দাদা ও বড় ভাই সূলভ আচরণ, সীমান্তে রাডার স্থাপন, অসম বাণিজ্য চুক্তি, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান, ভারতে মুসলিম নিধন, ভারতের মন্ত্রী এমপিদের বাংলাদেশ দখলের হুমকি, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত- পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে বক্তব্য দান ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের মানুষ আজ ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র মানতে পারছে না। এর জন্য কি বাংলাদেশের মানুষ দায়ী? মোটেও না। এই সংকট ভারতেরই সৃষ্টি।
বাংলাদেশের মানুষের চোখে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ ভাসে। আজ সরকারের এই অহেতুক ভারতপ্রীতির কারণে সীমান্তে ফেলানী হত্যার ১০ বছরেও হয়নি কোন বিচার। যেদিন ভারত সরকার ফেলানী হত্যার বিচার করবে, সেদিন থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। আর সীমান্ত হত্যা বন্ধ হলে এবং সম্মান ও মর্যাদার চুক্তি হলে বাংলাদেশের জনগণের সাথে ভারতের নতুন করে আবারও বন্ধুত্ব হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার জন্য দুই দেশ যে ‘রক্তঋণে’ বাঁধা পড়ে আছে সে কথাও যেমন সত্যি তেমনি এখন দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্কও যে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, সেই বিশ্বাসও থাকা উচিৎ অটল।
সরকারের ভারতপন্থী হওয়া কিংবা ভারতপ্রীতির অসংখ্য নমুনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এই যেমন – বাংলাদেশ কিডনি ইন্সটিটিউশনে প্রতিটি ডায়ালায়সিসের জন্য সরকার ভারতীয়দের জন্য ১৭০০ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে সরকার ৯০০ টাকা করে ভর্তুকি দিতে রাজি হচ্ছে না।
আবার বাংলাদেশ কে ভারত তাদের সমরাস্ত্র বিক্রি করতে চাচ্ছে। সব ধরনের সমরাস্ত্রই বাংলাদেশ কে সরবারহ করার প্রস্তাব দিচ্ছে। এর পিছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র! চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সম্পর্কের মাত্রা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে ভারত ভয় পাচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋন দিয়েছে শুধু ভারত থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করার জন্য। এখন প্রশ্ন এই শর্তে কেন সমরাস্ত্র কিনতে হবে আর তা ভারতের থেকেই?
বেইমানের আরেক নাম ভারত। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ফরমুলা নিয়ে তৈরি করার চুক্তি করে। চুক্তিতে উল্লেখ আছে সিরাম ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান টিকা এই অঞ্চলে আনতে পারবে না। এক কথায় বাংলাদেশ বর্তমানে শুধু মাত্র সিরাম ইনস্টিটিউট এর কাছ থেকেই টিকা পেতে পারে।
নতুন বছরের শুরুতেই বাংলাদেশের তথাকথিত বন্ধু ভারত আবারও সেই তথাকথিত বন্ধুত্বের আসল রূপ প্রদর্শন করলো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে ভোট না দিয়ে বরং হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলো। আসলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা কতিপয় ব্যাক্তি তাদের একান্ত ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নির্লজ্জভাবে ভারতের গোলামীতে ব্যাস্ত। স্বার্থলোভী এবং আখের গোছানো এই সরকার ভারত গিয়ে হেসে খেলে নিজের দেশের জন্য বাঁশ বয়ে আনছেন আর জনগণকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য। যে ভারত সরকার আমাদের দেওয়া জামদানী পড়ে আমাদের দেওয়া ইলিশ খেয়ে হাসি মুখে পানির প্রশ্নে না বলছেন তাদের সাথে ব্যক্তিস্বার্থে বন্ধুত্ব রক্ষা জনগণের সাথে প্রতারণা মাত্র।