আশির দশকে বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার লাল কার্ড প্রাপ্তিতে ক্ষুব্ধ ফুটবলপাগল দর্শক ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দিয়েছিল—ফিফার চামড়া তুলে নেব আমরা। সে তুলনায় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল আরও ভয়ংকর বিষয়। আগের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাংকের চামড়া তুলে ফেলার স্লোগান তাই হয়তো শোনা যেত ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মিছিলে। তাদের ‘অমার্জনীয় ব্যর্থতা’ অবশ্য কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরীসহ আমাদের কয়েকজন মন্ত্রী এবং কিছু বিশ্লেষক। তাঁদের বক্তব্য, বিশ্বব্যাংকের নিজের কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ, অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করেছে বলে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বরং সোচ্চার হওয়া উচিত আমাদের। ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন।
এমন কথা সিপিবি, বদরুদ্দীন উমর বা আনু মুহাম্মদ বললে তা আদর্শিক অবস্থান থেকে বলা ধরে নিতে হবে। অন্য অনেকে এসব বলেন সম্ভবত দলকানা হওয়ার কারণে, কিংবা বিশ্বব্যাংক আর সরকারের পারস্পরিক মাপ বোঝার অক্ষমতার কারণে বা নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য। তাঁদের বক্তব্য অসত্য নয়, কিন্তু এসব বক্তব্যের কার্যকরণের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য লবিং করে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের কেউ দুর্নীতি করে থাকতে পারে, বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ, বিশ্বব্যাংক দেশের সম্পদকে আন্তর্জাতিক পুঁজির অধীন করে ফেলে, উন্নয়ন সাহায্যের নানা শর্ত জুড়ে দেয়, তাদের শর্ত (বিশেষ করে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও পরিবেশবিরোধী বড় অবকাঠামো নির্মাণ) পালন করতে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশকে বিপদে পড়তে হয়েছে।
এসব সমালোচনা সত্যি হলেও বাংলাদেশের যেসব শাসকগোষ্ঠী যুগের পর যুগ বিশ্বব্যাংক ও সমগোত্রীয়দের নির্দেশনা মেনে দেশ চালিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে করা যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ঋণ বাতিল করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব সমালোচনা সময়োপযোগীও নয়। সরকারের পক্ষ থেকে এমন সমালোচনা আরও মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিশ্বব্যাংক এখনো বাংলাদেশে বহু প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, বিশ্বব্যাংকের অনুজপ্রতিম প্রতিষ্ঠান এডিবি এবং এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যেসব উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে, তাদেরও বহু প্রকল্প আছে বাংলাদেশে। একজন আবুল হোসেনের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ শুনতে হয় স্বয়ং সরকারপ্রধানের কাছ থেকে, তাহলে দাতাগোষ্ঠীকে আরও বড়ভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
সেই সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের?
২.
বিশ্বব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় চীন বা ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ চীন বা ভারত নয়। এ দুটো দেশেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে, কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় তা অনেক কম। তা ছাড়া চীন বা ভারতে ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা পর্যন্ত দুর্নীতি প্রমাণিত হলে চাকরি হারান, বিচারের সম্মুখীন হন, বাংলাদেশে তা কখনো হয় না। চীন-ভারতের অর্থনীতি, সরকারি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত সক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে বহু গুণে মজবুত। নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর চেয়েও অনেক বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা আছে তাদের। এরা বিশ্বব্যাংককে ঋণচুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়ে ঋণের শর্তাবলি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। চীন বা ভারতের তুলনায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা নগণ্য বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের যদি পর্যাপ্তভাবে এই ক্ষমতা থাকত কিংবা সরকার যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের খবরদারি অগ্রহণযোগ্য বলে জনগণের কাছে প্রমাণ করতে পারত, তাহলে সরকার ব্যাংকটির সমালোচনায় মুখর হলে তা মানানসই হতো। কিন্তু সে ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। সরকার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায়ও নেমেছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে সমালোচনা করছেন দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার পর। কাজেই এখন বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে নায়কোচিত কোনো ইমেজ গড়ে তোলা দূরের কথা, দেশে এবং বিদেশে নিজের সম্মান বাঁচানোই কঠিন হবে সরকারের জন্য।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের আগেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করলে সরকারের এমন সম্মানহানি হতো না। এ ধরনের তদন্ত যে হয়নি তার বিভিন্ন আলামত রয়েছে। তদন্ত চলাকালে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃক দুর্নীতি হয়নি বলে হাঁকডাক প্রদান, তড়িঘড়ি তদন্ত করে দুদক কর্তৃক মন্ত্রীকে দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট প্রদান, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আরও তথ্য প্রদানের পর নজিরবিহীনভাবে দুদকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তথ্য গোপনের চেষ্টা, ঘুষ গ্রহণের প্রস্তাব কোনো অপরাধ নয় বলে অসত্য প্রচারণা (পেনাল কোডের ১৬২ ও ১৬৩ ধারায় এটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ) পদ্মা সেতু প্রকল্পে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে।
তা ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কমিটমেন্ট নিয়ে এমনিতেই সন্দেহ পোষণ করার নানা কারণ রয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে আগের আমলে করা দুর্নীতির অসংখ্য মামলা ঢালাওভাবে প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী প্রকাশ না করা, শেয়ার মার্কেটে লুটপাট ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিচার না করা, কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন পাস করা, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা বিবেচনায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার সুযোগ দেওয়া, দুদককে ক্রমাগতভাবে দুর্বল ও পরাধীন করার প্রচেষ্টাসহ নানা দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরকার নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে, তা বিশ্বাস করাই ছিল কষ্টকর। সরকার সেই বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
৩.
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন অতিবিতর্কিত ব্যক্তিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানও দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করার কারণ রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী থেকে আবুল হোসেন প্রায় রাতারাতি অর্থের পাহাড় গড়েছেন, অসাধুতার কারণে শেখ হাসিনার প্রথম আমলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির গোপন তারবার্তায় সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে তাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এমন একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে ধারণাকৃত ব্যক্তিকে কেন হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের কাজ হবে এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কেন এসব প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের সংশ্লিষ্ট রাখা হয়েছিল, স্বার্থসংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) রয়েছে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের সেই প্রতিষ্ঠান তার পরিবারের মালিকানাধীন থাকা অবস্থায় কীভাবে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। পরে তাঁকে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর বেশি অর্থ রয়েছে, এমন একটি খাতের (টেলিযোগাযোগ খাত) সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগও ছিল সন্দেহজনক।
সরকার তাঁর বিভিন্ন সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড আড়াল করার জন্য বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একধরনের সমালোচনার জিহাদে নেমেছে এবং একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিয়ে প্রয়োজনে নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের আবেগকম্পিত ঘোষণা দিচ্ছে। ৩২ কোটি হাত দিয়ে বা এক বেলা বাজার করার অর্থ বাঁচিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলা হচ্ছে। এসব আহ্বান দিচ্ছেন এমন সব মন্ত্রী বা নেতা, জনগণের কাছে যাঁদের নিজস্ব সততাই প্রশ্নবিদ্ধ। নানা কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচিত সরকারের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানও আগের তুলনায় অনেক দুর্বল এখন।
সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় না, সরকারের আহ্বানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের জনগণ বা প্রবাসীরা অংশ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই অবস্থা রয়েছে দেশে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন দূরের কথা, দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত সরকারের মানসম্মান বাঁচানোই বরং কঠিন হয়ে পড়ছে এখন। বিশেষ করে, আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ একজন ব্যক্তি কেন এত অপরিহার্য এবং মূল্যবান সরকারের কাছে—এই অমোঘ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে। তাঁর মতো একজন ব্যক্তি তখনই অপরিহার্য হতে পারে, যদি তাঁর অপসারণ আরও বড় দুর্নীতিবাজদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা থাকে বা যদি মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান দুর্নীতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে খুব প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়।
৪.
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বহু অস্বস্তিকর তথ্য ও বিশ্লেষণ আমরা পেতে পারি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, কানাডা সরকারসহ আন্তর্জাতিক মহল জড়িত হয়ে পড়ায় এই প্রকল্প নিয়ে তথ্য গোপন করা সম্ভব হবে না কারও পক্ষে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকও তার শক্তিশালী প্রচারণা কাঠামোকে থামিয়ে রাখবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে যাওয়ার আগে সরকারকে ধীরস্থিরভাবে বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। আবুল হোসেনকে নিজে থেকে পদত্যাগ করার মেসেজ দিয়ে সরকার নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ইতিবাচক সূচনা করতে পারে।
সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত প্রমাণ করা এবং এভাবে নিজের মানসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেটি করা সম্ভব হলে বিশ্বব্যাংক না থাকলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে সমস্যা হবে না। সরকারকে বুঝতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আর।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।