ভারতের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুনভাবে শুরু করে কি না সবাই তা দেখার আগ্রহে রয়েছেন। পাঁচ-ছয় বছর ধরে এটা সবার কাছে পরিষ্কার ছিল যে, বিগত কংগ্রেস সরকার শেখ হাসিনার সরকারকে তাদের বিশেষ পছন্দের সরকার হিসেবে পেয়েছিল। অবস্থা ছিল যেন বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হলেও নিজের স্বার্থকে ভারতের স্বার্থের অধীনস্থ রেখে সরকার চালানোর নীতি বিন্যাসের জন্যই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সেটা নদী ভরাট করে ভারতীয় যান চলাচলে বিনা খরচের ট্রানজিট দেয়া থেকে শুরু করে সীমান্তে বিএসএফের নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যার জন্য উল্টো ভারতের পক্ষেই সাফাই গাওয়া পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে দেখা গেছে। এ ছাড়া খুবই কৌশলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অসংখ্য অমীমাংসিত ইস্যু থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে সাইডলাইনে রেখে যেন কেবল তিস্তার পানিবণ্টন আর সীমান্তে ভূমি বিনিময়Ñ এ দুটোতে নামিয়ে আনতে মিডিয়ায় প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ওই দু’টি ইস্যুতেও কোনো ধরনের মীমাংসা ছাড়াই কংগ্রেস সরকারের সময়কাল শেষ হয়েছে। এর পরও হাসিনার পাঁচ বছর শাসনের শেষে ভারতের আবদার আর শেখ হাসিনার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নীতি ছিল হাসিনাকেই আবার ক্ষমতায় চাই, তাতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা জাহান্নামে যাক তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবে বাংলাদেশ ছিল ভারত সরকারের তথাকথিত ‘নিরাপত্তা স্বার্থের’ এক অবারিত অভয়ারণ্য। কংগ্রেসের এই আগ্রাসী ও জবরদস্তির নীতির সহায়ক ছিল ভারতের আমলা, কূটনীতিক ও গোয়েন্দা বিভাগ, আর সবার ওপরে ছিল ভারতীয় মিডিয়া। সবাই একটা বিষয়ে একমত হয়ে কাজ করেছিল যে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের নামে তাদের পড়শি অপর রাষ্ট্রে যা খুশি করার জন্য বাংলাদেশকে নিজেদের সামনে অবারিত রাখতে হবে। আর এটাই নাকি বাংলাদেশের ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র হওয়া এবং দিল্লির সাথে সম্পর্ক ভালো থাকার মডেল।
অমীমাংসিত ইস্যু হিসেবে যে দু’টিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়, তা নিয়েও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ম্যানেজড মিডিয়াও লজ্জায় পড়ে। মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে না পেয়ে এদের কেউ কেউ শেষ বছরে কংগ্রেস সরকারের মৃদু সমালোচনা শুরু করে সরকারের সাথে নিজেদের দূরত্ব প্রকাশের চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে নিজেদের দায়দায়িত্বও অস্বীকার করে।
এটা পরিষ্কার যে, নতুন মোদি সরকার কংগ্রেসের এই নীতি ভারতের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকারক হয়েছে, এমন ভাবতে শুরু করেছে। মোদির বিদেশনীতির মুখ্য ফোকাস অর্থনৈতিক উন্নতি বা নিজের জনগণকে কাজ দেয়ার চ্যালেঞ্জ। অন্যভাবে বললে, আসন্ন গ্লে¬াবাল অর্থনৈতিক ওলটপালটের সুবিধা বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার করে ফাইন টিউনের মধ্য দিয়ে নিজের সামনে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হওয়ার যে সুযোগ দেখা দিয়েছে তাকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা। বিপরীতে কংগ্রেসের ফোকাস ছিল তথাকথিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। মোদির হুঁশ-জ্ঞানের সাথে যদি তুলনা করি তবে বলতে হয় কংগ্রেস অবুঝ শিশু, পোলাপান। প্রথমত, ভারতের গ্লোবাল সম্ভাবনার কথা কংগ্রেস হয়তো বুঝতে পারেনি। অথবা বুঝেছে আমেরিকান স্বার্থের ফাঁদে পড়ে। কংগ্রেস মনে করেছে, গ্লোবাল অর্থনৈতিক ওলটপালটে সুবিধা কথার অর্থ আমেরিকার ভারতের পিঠে হাত রাখা। আর তাতে ভারত অর্থনৈতিক অর্থে নয়, রাজনৈতিক ও স্ট্রাটেজিক অর্থে পরাশক্তির ভূমিকায় এসে গেছে। সে মৌলিক বিবেচনায় নেয়নি যে নিজের অর্থনৈতিক ভিতের ওপর না দাঁড়িয়ে কেউ রাজনৈতিক পরাশক্তি হতে পারে না। কংগ্রেস আমেরিকার ওয়ার অন টেররের মধ্যে নিজের বিশাল সম্ভাবনা দেখেছে, আমেরিকান যাঁতাকাঠি হাতে পেয়ে নিজের আঞ্চলিক মোড়ল হওয়ার চকচকে লোভে পড়েছে, ফাঁদে পড়েছে। অথচ গ্লোবাল অর্থনৈতিক পরাশক্তিগত যে ওলটপালট চলছে এর প্রধান অভিমুখ ও ইঙ্গিত হলো ভারতের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা। আর কোনো রাষ্ট্র অর্থনৈতিক পরাশক্তি হলে সেই সাথে তার রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিক পরাশক্তি হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর সেটা এমন নিজের পায়ে দাঁড়ানো, যা অন্য কেউ চাইলেও অস্বীকার করতে পারে না। মোটা বুদ্ধির শর্টকাটে লোভী কংগ্রেস শুধু নিজের পায়ে কুড়াল মারেনি, এই অঞ্চলে সবচেয়ে ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের।
এককথায় বললে কংগ্রেসের ফোকাস ছিল অর্থহীন তথাকথিত ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা’ আর বিপরীতে মোদির ফোকাস অর্থনীতি। আবার এর মানে এমন নয় যে, মোদি ভারতের সত্যিকারের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে খাটো করছেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফকে তিনি বলবেন, ডিল রফা করবেন এভাবে যে কাসাবদের মুম্বাই হামলার মতো বিষয়গুলো আর না ঘটার বিষয়ে তিনি পাকিস্তানের নীতিগত সক্রিয়তা ও কাজে নিশ্চয়তা চান। আর এই নিশ্চয়তা নিয়েই তিনি পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের সবাই মিলে এক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট করে সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটতে চান। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি আসলে আলাদা নয়, গ্লে¬াবাল অর্থনৈতিক ওলটপালটের সুবিধায় এশিয়ার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেই অর্থনীতি ফোকাসে পথচলার অবিভাজ্য অংশ।
দুই ফোকাসের ভাগ অর্থনৈতিক উন্নতি বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাÑ এটা কি কাল্পনিক। না তা নয়। মোদির সরকারের বয়স মাত্র এক মাস। এ সরকারের নীতিগত দিক কী হতে যাচ্ছে, তার অনেক কিছু অনুমান করা গেলেও লিখিত ডকুমেন্টে এখনো তা যথেষ্ট হাজির নয়। তবু সুষমার এই সফরে তার এক লিখিত বক্তব্য আমরা ইতোমধ্যেই হাতে পাই। ঢাকায় সুষমার কর্মসূচিতে এক সেমিনারে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তিনি যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। সুষমা এই সফরে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই যে এসেছিলেন, এর ছাপ সব জায়গায় আছে। যেমন ভারতের নতুন সরকারের দিক থেকে দেখলে তারা বুঝেছিলেন, গত ছয় বছরে কংগ্রেস বাংলাদেশে যথেচ্ছাচার তাণ্ডব করেছে, তাতে অর্থনৈতিক বা স্ট্রাটেজিকভাবে ভারতের জন্য এমন কোনো ফল আনেনি, যা টিকে থাকবে। এই সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে আবর্জনা জমেছে। বিশেষত ওই আবর্জনা পরিষ্কার না করে ওর ওপরে মোদির নতুন কোনো নীতি অকার্যকর হবে তা মোদি ও তার নীতিনির্ধারক টিমের লোকজনের উপলব্ধি হয়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। যেমন ভারতের অর্জনের দিক থেকে দেখলে এখন ভারতের সামনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এক হাসিনার বাংলাদেশ আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা ভারতের জন্য এক বিশাল দায়। এর মূল কারণ ক্ষমতা ভিক্ষা করা হাসিনার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ হাসিল করে আছে ঠিকই, কিন্তু হাসিনারই নিজ দেশে কোনো ভিত্তি নেই। অন্তত পাবলিক রেটিংয়ের দিক থেকে যদি বলি, এটা যতটাই শূন্য ভারতের জন্য ততটাই বোঝা। কারণ, এই রেটিংশূন্য হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো লাভালাভের সুবিধা ভারত পেতে পারবে না। যদি জবরদস্তির মাধ্যমে সে পথে যেতেও চায় তবে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার সরাসরি বিরুদ্ধে গিয়ে মোদির ভারতকে দাঁড়াতে হবে। এটা ভারতের সুবিধা নয়, লায়াবিলিটি।
ওদিকে মোদির দরকার বাংলাদেশকে এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পার্টনার হিসেবে দেখতে চায়। কংগ্রেসের মতো ভারতের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে এক দাস বাংলাদেশ নয়; মুক্ত ও সক্রিয় পার্টনার বাংলাদেশকেই তার চাই। এগুলো সুখস্বপ্ন, কল্পনা নয়। সুষমা লিখিত বক্তব্যে বলছেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি ভারতের (অর্থনৈতিক) বিকাশ টিকে থাকার মতো স্থায়ী ও সম্পূর্ণ হতে পারে না, যদি সংলগ্ন পড়শিদের সাথে কার্যকর সক্রিয় পার্টনারের সম্পর্ক আমরা তৈরি করতে না পারি। তাই আমরা আমাদের বিকাশের লক্ষ্যাভিমুখে পড়শিদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আমাদের শক্তি ব্যয় করব। এই অঞ্চলের এমন সুযোগ সুবিধা আর দায়িত্ববান সমৃদ্ধির চক্র তৈরি করতে নিজেরাই আগবাড়িয়ে বাড়তি পথ হাঁটব। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যাতায়াত, অবকাঠামোগত সক্ষমতা ও এক পরিবেশ সহায়ক চর্চা তৈরির মাধ্যমে ও উপায়ে আমাদের অর্থনীতিগুলোকে পারস্পরিক পরিপূরক ও আন্তঃনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে আমরা জোর দেবো, যা এই অঞ্চলে সবার সমান বিকাশ এগিয়ে নেবে।’
অনেকের মনে হতে পারে কূটনীতিক বাকচাতুরী ভাষায় এ রকম অনেক কথাই তো বলা হয়, এটাকে এত গুরুত্ব দেয়ার কী আছে। কিন্তু এই বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবেÑ ১. গ্লোবাল অর্থনীতি এখন এশিয়ামুখী। ২. দুনিয়ার আগামী নির্ধারক দুই অর্থনীতি চীন ও ভারতকে কেন্দ্র করেই এশিয়ায় গ্লে¬াবাল অর্থনীতি আবর্তিত হবে। ৩. চীন ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সক্ষমতার পার্থক্য আছে, আর এই দেশ দুটোর ঠিক মাঝেই বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সক্ষমতার পার্থক্যের ভেতর জোটের নীতিগত সাম্য এবং ভারসাম্য তৈরিতে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। ৪. কেবল ভৌগোলিক অবস্থান নয়, BCIM (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার মিলিয়ে যে অর্থনৈতিক জোট)-এর লক্ষ্য যতটা না এই অঞ্চলের চার দেশের নিজেদের জোটবদ্ধ শক্তি হওয়া, এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জোটের বাইরে নয়, বরং এই চার দেশের প্রত্যেকের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সুষম বিকাশের দিকটি। কারণ, এই BCIM অঞ্চল মূলত চীন ও ভারত উভয়েরই ল্যান্ডলকড পূর্বাঞ্চল। যার আবদ্ধ অবস্থা থেকে সরাসরি সড়ক রাস্তাঘাটের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত যোগাযোগের দুয়ার খোলার উপায় BCIM জোট। ফলে তা এই অবরুদ্ধ অঞ্চলগুলোতেও সমান বিকাশের উপায়। আর এই মুক্তি ঘটবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভূমির ওপর দিয়ে এবং বাংলাদেশে নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে। ফলে ‘ভারতের বিকাশ পড়শিদের ওপর নির্ভরশীল আর স্থায়ী ও সম্পূর্ণ হওয়ার উপায়’- এ কথাটি একেবারেই বাকচাতুরী কূটনৈতিক বিচারে ঠিক নয়। সুষমা বা মোদি এ কথা বুঝতে পেরেছে, তা স্বীকার করলে বা না করলেও তখনো এটা সত্যি। এ ছাড়া প্রত্যেকের অভ্যন্তরীণ বিকাশের দিক মুখ্য করে এই অর্থনৈতিক সহযোগিতার জোট যদি ঠিকমতো দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তবে এশিয়ার বাকি অঞ্চলের ওপরে এই জোট ভারকেন্দ্রের ভূমিকায় চলে আসবে।
এই জোট গঠনের চিন্তা বাংলাদেশ থেকে সঙ্কীর্ণ ভারতের জবরদস্তিতে ও বিনা পয়সায় ট্রানজিট আদায় করার মতো মুদিদোকানি ভাবনা নয়। কংগ্রেসের ভারত নেহায়েতই মুদিদোকানি ভাবনা যে ভেবেছে তা বোঝা যায় তাদের আগের পদ্ধতির দিকে দেখলে। তারা জোর দিয়েছিল ট্রানজিট অনুমতির কাগজ জোগাড়ে এবং তা বিনা পয়সায় হতে হবে। কিন্তু কাগজের ওপর দিয়ে তো ভারতীয় মালামাল পারাপার হবে না, বাস্তব রাস্তাঘাট অবকাঠামো লাগবে, যেই সেই নয়, ভারী যানবাহন চলার অবকাঠামো, ট্রাফিক রুল, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি অনেক কিছু। এমনকি বাংলাদেশের নিরাপত্তা স্বার্থকতা বাদও যদি দেই, তবুও তাতে ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে একটা কিছু লাগবে। ফলে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার ভারী রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ লাগবে, যেটা বাংলাদেশ দূরে থাক ভারতও জোগানোর সামর্থ্য রাখে না। ফলে BCIM -কেই জোটবদ্ধভাবে এর প্রয়োজনীয় ফান্ড জোগাড় করতে হবে। এবং এটা সম্ভব শুধু নয়, অন্য বিনিয়োগদাতারা অপেক্ষাও করছেন। কিন্তু এই বাস্তব দিকে ভারতের কোনো আগ্রহ নেই। মুদিদোকানি যেন ধরেই নিয়েছে ভারতের ট্রানজিটের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ চাহিদা বাংলাদেশের অর্থনীতিই পূরণ করে যাবে। অথবা হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে এই সরকারের কাছ থেকে একটা অনুমতির কাগজ হলেই তো ভারতের হবে। এ জন্যই একে মুদিদোকানি বলছি, যে নিজেকে ক্ষুদ্র করে রাখে, নিজেকে ক্ষুদ্র স্বার্থের আলোকে হাজিরও করে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে তার ভারতের শত্রু হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই, উদ্দেশ্য আর লক্ষ্যও হতে পারে না, ফায়দাও এতে নেই, যদি না সেটা যে করেই হোক দেশের স্বার্থে না হয়ে কেবল হাসিনার ক্ষমতায় থাকতেই হবে- এ ধরনের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে হয়। ভারত-বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যুর কিন্তু শেষ নেই, বরং বাড়ছে। সেগুলোকে জবরদস্তিতে অমীমাংসিত ফেলে রেখে কেবল ভারতের এবং সঙ্কীর্ণ করে তা ট্রানজিটের কাগজ ধরনের উপস্থাপনের চিন্তায় কংগ্রেস গত ছয় বছর চালিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অমীমাংসিত সব ইস্যুগুলোর একটা প্যাকেজ ফয়সালা হলে ভারতের সাথে BCIM-এ জোটবদ্ধভাবে বিকাশে শামিল না হতে বাংলাদেশের আপত্তির কিছু নেই, থাকতে পারে না। সেখানে তখন কেবল ভারতের ট্রানজিট খুবই ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বিষয়। বরং BCIM -এর ট্রানজিট হাব হওয়ার মধ্যেই আসলে বাংলাদেশের সব স্বার্থ লুকিয়ে আছে। তবে অবশ্যই তা কোনো জবরদস্তিতে নয়, সমান ও সম লাভের জোট পার্টনার হিসেবেই।
সুষমা এ কথারই প্রতিধ্বনি করছেন। সুষমা তার বক্তব্যে বলছেন, ‘এক সুস্থির, সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া দেখার আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ এক সামগ্রিক ও সমমর্যাদার পার্টনার, এই সম্পর্ক তৈরি করা মৌলিকভাবে জরুরি। আমাদের ইতিহাস ও ভূগোল আমাদের একত্রে বসবাসের ভাগ্য ঠিক করে দিয়েছে। এটা কী করে করব তা আমাদেরই হাতে, একান্তই আমাদের হাতে। এখানে ‘সামগ্রিক’ ও ‘সমমর্যাদার পার্টনার’ শব্দ দুটো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
অর্থনীতি বনাম তথাকথিত নিরাপত্তা- কার কী ফোকাস, এভাবে কংগ্রেস ও মোদির বিজেপির তুলনা করেছি। কংগ্রেস মনে করেছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতরাজ্যের বিদ্রোহ সমস্যা শুধুই ভারতের নিরাপত্তার সমস্যা। ওদের দমন করে আর বাংলাদেশে শিখণ্ডি হাসিনার ক্ষমতা থাকা নিশ্চিত করার ভেতরেই ভারত সাত রাজ্য সমস্যার সমাধান। গত সাত বছর কংগ্রেস সমস্যাটা দেখেছে ‘সাত রাজ্য যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়’ এই নীতিতে। ফলে এটা ভারতের নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে দেখা গেছে। কিন্তু মোদির দেখার চোখ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোদি অত্যন্ত সঠিকভাবে সমস্যার গোড়ায় তাকিয়েছেন। মোদির চোখে ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর এমন সমস্যার সমাধান বল প্রয়োগ বা নিরাপত্তা নয়। রিসোর্স অ্যালোকেশন অর্থাৎ সম্পদের বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই একমাত্র এর সমাধান। এসব রাজ্য ছোট অর্থনীতির, ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদ মানে বিনিয়োগের ক্ষমতা কম, ফলে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। মোদি কথাটা তুলেছিলেন সাত রাজ্যকে কেন্দ্র করে নয়, মমতার পশ্চিমবঙ্গ প্রসঙ্গে। মমতার দেখার মধ্যেও সঙ্কীর্ণতা আছে, আছে অর্থনীতিকে মানবতা দেখানোর কাজ ভেবে বিচার করার ঝোঁক। তিনি গরিব মানুষকে প্রায় সরাসরি অর্থ বিতরণের মতো বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের এক কর্মসূচি চালাচ্ছেন। মমতা বলছেন, তিনি তার রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে অর্থ জোগাড় সম্ভব কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি জোগাড়ে সমর্থ হয়েছেন। ছোট অর্থনীতির পশ্চিমবঙ্গও এমনিতেই ছোট উদ্বৃত্ত সম্পদের ফলে সক্ষমতায় ভোগে। আর এই অভাবের আকাক্সক্ষা মেটাতে মমতা মনে করেন কেন্দ্রের বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এভাবেই এর সমাধান। বিপরীতে মোদি বলছেন, এটা কোনো সমাধান নয়। বসিয়ে ভর্তুকিতে খাওয়ানো নয়, বরং কাজ সৃষ্টির ফলে বিনিয়োগ এর সমাধান। ফলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিনিয়োগ জোগাড় করে দেয়া কেন্দ্রের দায়িত্ব মনে করেন তিনি। অর্থাৎ আমরা দেখছি, কংগ্রেস যেটাকে যুদ্ধবাজ দমনের সঙ্কীর্ণ চোখে নিরাপত্তার সমস্যা হিসেবে দেখে, মোদি সেটাকে বিনিয়োগ অর্থনীতিক বিকাশের সমাধান হিসেবে দেখেন। দুটো অ্যাপ্রোচের আকাশ-পাতাল ফারাক এখানে।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও কূটনীতিক সীমা লঙ্ঘন করে হাসিনাকে পুনঃক্ষমতায় আনার নীতি দেশে-বিদেশে সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করেছে। বাংলাদেশের জনগণ যাকেই ভোট দিতে চাক, নিজেদের প্রতিনিধি মনে করতে চাক সেগুলো তুচ্ছ। কংগ্রেসের হাসিনাকেই ক্ষমতায় চাই। এই ছিল কংগ্রেসের নীতি অবস্থান। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং নির্বাচনের ঠিক আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যেই সেসব তৎপরতা চালিয়েছিলেন। এর কয়েক মাসের মধ্যে ভারতের নির্বাচনে খোদ সেই কংগ্রেসের ১০ ভাগের কম আসনপ্রাপ্তিতে ভরাডুবি এবং বিপুল ভোটে মোদির উত্থান এই পটভূমিতে সুষমা বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কংগ্রেসের ভূমিকা হাসিনা ও তার কিছু সুবিধাভোগী ছাড়া বাংলাদেশের সবার মনে দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। সুজাতা ছাড়াও আর এক প্রকাশ্য প্রবক্তা হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন। তিনিও ভারতের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত ভারতের বাংলাদেশনীতি অপরিবর্তিত থাকবে বলে অন্তত দু’বার প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু মোদির বিপুল বিজয়ের পর পঙ্কজ ঠিক সময়মতো তওবা পড়ে নিয়েছেন। একাত্তর টিভিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে যেটা বিডিনিউজ২৪ ট্রান্সস্ক্রিপ্ট করে ১৩ জুন ছাপিয়েছিল।
এই সাক্ষাৎকার অনেকটা ‘আমরা আমরাই তো’ ধরনের। তবু পঙ্কজের পিছ-পালানোটা বেশ তামাশার। বলছেন, ‘কিন্তু আমি আগে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তার সাথে আজকের সময়ের অনেক পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় তফাৎ হলো আমাদের এখন নতুন একটি সরকার আছে।’ ‘সময়ের অনেক পার্থক্য আছে’, ‘বড় তফাৎ হলো আমাদের এখন নতুন একটি সরকার’- এই বাক্যাবলিতে তিনি এবার হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন। সুজাতা বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক প্রয়োজনেই নির্বাচন হয়েছে’ এই প্রসঙ্গ সেখানে এসেছিল। তা তিনি এখানেও সমর্থন করেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ সংবিধানই বদলে নেবে কি না সেটা তো বাংলাদেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন এবং বাংলাদেশের রাজনীতি এই ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে আছে। সেখানে ভারতের কোনো এক পক্ষের দিকে পছন্দ প্রকাশ মারাত্মক গর্হিত ও এমন ‘মন্তব্য করা ভারতের জন্য ধৃষ্টতার শামিল’ এবং লজ্জার মাথা খেয়ে সুজাতা তাই করেছিলেন।
অপর দিকে ‘অ্যারেঞ্জড সাক্ষাৎকার’ দিয়ে পঙ্কজ তওবা করে বাংলাদেশে তার চাকরি রক্ষা করে টিকে আছেন। কিন্তু আরো বড় কালপ্রিট সুজাতা সিং তিনি তো এখনো পররাষ্ট্র সচিব। এখন সুষমার সমস্যা নিজের মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ছাড়া বাংলাদেশে আসতে পারেন না। আবার সুজাতার কৃতকর্মের জন্য তিনিও বাংলাদেশে প্রেসে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যেতেও পারেন। এসব মিলিয়ে সুষমার এই সফর ছিল কংগ্রেসের কৃত পাপ-আবর্জনা থেকে নিজ সরকারকে মুক্ত করার সফর। ড্যামেজ কন্ট্রোলের সফর। তাই সুষমা নিজেকে এবং সুজাতাকেও বাংলাদেশে মিডিয়া থেকে দূরে রেখেছিলেন। মন্ত্রী বা সচিবের বাংলাদেশ সফরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এর আগে কখনোই সঙ্গী হননি। কিন্তু এবার মন্ত্রী ও সচিব দু’জনই আসা সত্ত্বেও তিনি এসেছেন এবং একা এককভাবে প্রেস সামলিয়েছেন। সেই সাথে আসার আগে নিজ সরকারের সবাই মিলে হোমওয়ার্ক করে সাব্যস্ত করা বক্তব্যটিই দিয়েছেন,‘সরকার সরকারের সাথে কাজ করে’ আর সেই সাথে ‘তারা বাংলাদেশের জনগণের সাথে কাজ করতে চান’। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট হাসিনা তাদের আগ্রহের বিষয় নয়, এ কথাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রকাশ করলেন। অনেকে মনে করতে পারেন, এটা জোর করে টেনে ভারতীয় মুখপাত্রের কথা পাঠ করছি। আসলে তা নয়। এর প্রমাণ হিসেবে আগে উদ্ধৃত সুষমার ওই লিখিত বক্তব্যের আর কিছু অংশ তুলে আনব।
‘আমি জানি এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে ভারতীয় নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বাংলাদেশে খুব মনোযোগের সাথে অনুসরণ করা হয়েছে। অনেকে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এ জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। এই নির্বাচন কেবল দুনিয়ার এক বৃহত্তম গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। এটা একই সাথে ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিকতা পরিমাপে এক মোড় ঘুরানোর মতো ঘটনা ছিল। এটা ছিল আশা-ভরসার নির্বাচন। আমি আপনাদের সামনে সরকারের এক প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি, যারা একটা নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে; যেটা বিরাট এক ত্রিশ বছরের গ্যাপ, এবারই ভারতের জনগণ কোনো একক রাজনৈতিক দলের পক্ষে পরিষ্কার রায় দিয়েছে। আমার সরকারের বিদেশনীতি হবে সব দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে উন্নীত করার নীতিতে অসঙ্কীর্ণ করে দেখা (এনলাইটেন্ড) জাতীয় নিজ স্বার্থ অনুসরণ করবে। অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বুঝি, গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী (রাষ্ট্রীয়) প্রতিষ্ঠান তৈরি আর মতভিন্নতাকে সহ্য করা, সাথে নেয়ার ও সম্মান করার সংস্কৃতি দরকার হয়। মতভিন্নতাকে সামলানোর এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা মীমাংসার সক্ষমতার ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের শক্তি প্রমাণ করা যায়। আমরা কিছু সার্বজনীন মূল্যবোধ ধারণ করি, যেখানে সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। এ ব্যাপারে যদি চাওয়া হয়, আমরা আমাদের চর্চার ভালো মাপের উপায় ও আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের সাথে আনন্দে শেয়ার করতে পারি।’
উদ্ধৃতিটি টুকে এনেছি তিনটা অংশ থেকে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়ার সাথে সুষমার সাক্ষাতে কী কথা হয়েছে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ সম্পর্কে বিএনপির মঈন খান জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। তথাকথিত সংসদ জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে না। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ তার প্রতিবেশী দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চায় কি না, তা আলোচনায় উল্লে¬খ করা হয়েছে’ (২৭ জুন প্রথম আলো)। মঈন খানের এটা খুবই দাসত্বমূলক মনোভাব। যদিও খালেদা ঠিক এই ভাষায় সুষমাকে এ প্রসঙ্গে বলেছেন কি না জানার উপায় নেই। বলে থাকলে সেটাও দাসত্বমূলক। অর্থাৎ বিএনপি কোনো হোমওয়ার্ক করে যায়নি অথচ মনের ভেতর দাসত্বভাব রয়ে গেছে; এরই প্রকাশ এটা। ভারত বাংলাদেশে কেমন অথবা এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে চায় কি না, ভারতকে এই সুযোগ বা অপশন আমরা দিতে পারি না। এটা যেচে ভারতের দাসত্ব নেয়া, বরং যেটা খাড়া অথচ কূটনৈতিক শোভন কথা হতে পারত- ‘বাংলাদেশের গত নির্বাচন উপলক্ষে ভারতের বিগত সরকারের নেয়া একপেশে ও পক্ষপাতিত্বমূলক (ইচ্ছা ও সাহসে কুলালে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত যোগ করতে পারেন) অবস্থান আমাদের হতাশ করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র অনুপস্থিত। তথাকথিত সংসদ জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে না। ভারতের নতুন সরকার বিষয়টিকে কিভাবে দেখে আমরা জানতে আগ্রহী’ এভাবে বলা যেত। ঠিক এভাবেই বলতে বলা হচ্ছে না, তবে মূলভাব অবশ্য এমনই হতে হতো। অর্থাৎ ভারতকে নাক গলানোর কোনো অপশন দেয়া নয়, বরং তাদের নীতি কী, ওর পরিণতি কী এ সম্পর্কে অসন্তুষ্টি জানানো। বিএনপির মতো ‘অবিপ্ল¬বী’ দলের পক্ষেও ভারতের নীতিতে হতাশা জানানো কঠিন কোনো কাজ নয়।
টুকে আনা সুষমার উদ্ধৃতির প্রথম অংশ স্পষ্টতই পরোক্ষে হাসিনাকে নিজেদের মনোভাব বুঝিয়ে দেয়া যে, ভারত গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বের মতো কোনো বিষয়কে কিভাবে দেখে এবং হাসিনা তেমন প্রতিনিধি নয়, সেটাই মনে করিয়ে দেয়া। সুষমার দলের মতো ত্রিশ বছর অপেক্ষা করে হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে দুর্বল করে দেয়া উচিত নয়, জবরদস্তি খাটিয়ে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করা উচিত নয়। ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর মতো করে কথাগুলো এভাবেই সুষমা বলে গেছেন।
উদ্ধৃতির মাঝের অংশ : একটা বাক্যের এই উদ্ধৃতিটি সাদামাটা কূটনৈতিক বাক্যই, তবে একটা শব্দ ছাড়া। শব্দটা হলো এনলাইটেনড সেলফ ইন্টারেস্ট। বাংলা করেছি, ‘অসঙ্কীর্ণ করে দেখা জাতীয় নিজ স্বার্থ’। শব্দটা ইন্টারেস্টিং। রাষ্ট্রের কাজই হলো নিজ স্বার্থ মানে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ দেখা, সেজন্যই ওটা রাষ্ট্র। কেবল নিজ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর কমন স্বার্থ দেখভাল করাই ওর কাজ। কিন্তু নিজ স্বার্থ মানে কী? অনেক সময় আঞ্চলিক স্বার্থের ভেতর নিজের মুখ্য স্বার্থ থাকে সেগুলো সঙ্কীর্ণ চোখে না দেখাই বুদ্ধিমানের, আরো বড় লাভের দিক থেকে দেখার মতো চোখ সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্থে এনলাইটেনড শব্দটি প্রয়োগের প্রশংসাই করতে হয়।
টুকে আনা সুষমার বক্তৃতার শেষ অংশ : মতভিন্নতাকে জায়গা করে দেয়া, একপাত্রে ধরা, সহ্য করা- কেন গুরুত্বপূর্ণ সে প্রসঙ্গে এটা সুষমার সবক। এখানে বড় তামাশাটা হলো, হাসিনার আওয়ামী লীগ নিজেদের সেকুলার রাজনৈতিক শক্তি বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, বিপরীতে বিজেপি সম্পর্কে তাদের রিডিং হলো সাম্প্রদায়িক দল। কিন্তু সেই বিজেপি সরকারের কাছ থেকেই হাসিনাকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের অর্থ কী, গণতন্ত্রের কোর ভ্যালু মতভিন্নতাকে কিভাবে দেখতে হয় এর সবক শুনতে হলো।
সামগ্রিকভাবে দেখলে, কংগ্রেসের বাংলাদেশ নীতির বিপদ ও আত্মঘাতী দিক মোদির বিজেপি উপলব্ধি করে কিন্তু অন্য দেশ সফরে এসে তা প্রকাশ্যে বলতে পারে না। কিন্তু তাদের উপলব্ধি কী সেটা তারা পরিষ্কার করেছে সুষমার ওই সেমিনারের লিখিত বক্তৃতায়। সুষমার সফরে সামগ্রিক বিচারে হাসিনা বেচতে চেষ্টা করেছেন ভারতের ‘নিরাপত্তা স্বার্থ’ রক্ষার্থে তিনি কত কিছু করেছেন সে কথা। কিন্তু মোদির চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি নীতি কিছুই হাসিনা স্টাডি করেননি। মোদি আসলে এগুলো কিনতেই আসেননি। ভারতের ‘নিরাপত্তা স্বার্থ’ কিনতে তিনি আগ্রহী নন। এটা তার ফোকাস নয়। তার ফোকাস আঞ্চলিক অর্থনীতিতে এক বড় ভূমিকা যেখানে তার লক্ষ্য আরো অন্য অনেক কিছু, দেয়া-নেয়ার সমমর্যাদার পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশ। ফলে বলাবাহুল্য অপ্রতিনিধিত্বের হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে কোনো মদদে তার ঠেকা নেই। হাসিনা তার কাছে নিজ চাহিদার পক্ষে কোনো সম্পদ নয়, দায়।