২০১৩ সালের পর থেকেই বাংলাদেশে গুম-খুন-হত্যার বিষয়টা ব্যপক ভাবে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ হঠাত করেই রহস্যজনক ভাবে ‘গুম’ হয়ে যাচ্ছেন। কারা এই অপহরণ করে যাচ্ছে একের পর এক? অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্য থেকেকেউ কেউ ছাড়া পাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ একদম উধাও হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে এমন অপহরণ, গুম বা অপহৃত ব্যক্তির আকস্মিক মুক্তিলাভ অতীতে দেখেনি জনগণ। দলমত, পথ, মতামত যে যার হোক, সকলের একটাই প্রশ্ন-কারা করছে এ সব? সরকার নীরব, প্রশাসন নীরব। অপহৃত হয়ে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরাও রহস্যজনক নীরবতা পালন করছেন। আর এ কারণেই জনমনে ‘অপহরণ, গুম ও মুক্তিলাভ’ নিয়ে অপার রহস্য ছড়িয়ে পড়ছে। সচেতম মহলের প্রশ্ন-প্রকাশ্যে বা রাতের অন্ধকারে যে কোন স্থান থেকে বা কারো বাড়ি থেকে কে বা কারা অনায়াসে মানুষকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে? একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে, অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন তৎপরতা নেই। যারা অজ্ঞাত বন্দিশালা থেকে ফিরে আসছেন, তাদের নিয়েও কোন তদন্ত হচ্ছে না। অপহরণ হবার ঘটনার কারণ উদঘাটন করতে তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। কেন? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই রহস্যজনক নীরবতার কারণে সন্দেহের তীর বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার দিকে। আবার অনেকে মনে করেন দেশের বাইরে থেকে ভাড়াটে কোন বাহিনী এ কাজ করছে। মুক্তি পণ আদায় করতে সংঘবদ্ধ অপহরণকারী দল এ কাজ করছে-এমন কথা দিনদিন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এ কারণে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলটির প্রতি শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এতে চাপা পড়ে যাচ্ছে সরকারের উন্নয়ন ও সফলতার অনেক কীর্তি।
এদিকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন যারা অপহৃত হয়ে ফিরে আসছেন, তাদের অপহরণের গল্প একই রকম এবং তারা চুপ মেরে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকারের যারা কট্টর সমালোচক এবং রাজনৈতিক বিরোধী তারা দাবি করেন কারা অপহরণ ও গুম করছে-তা মিডিয়ার কর্মীরা জানেন। কিন্তু নিজেরাই গুম হবার ভয়ে তা প্রকাশ করেন না মিডিয়া কর্মীরা। তারা এ ধরনের অপহরণ ও গুমের নেপথ্যে ডিজিডিএফআই, র্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ জড়িত বলেও দাবি করেন। তবে এর সপক্ষে কোন প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। তাদের এই দাবি দেশের কোন মিডিয়ায় প্রকাশও পায়নি। দেশের বাইরে বিভিন্ন ওয়েব-পোর্টালে এ সব অভিযোগ প্রকাশ করছেন তারা। ঐ সব ওয়েব বা পোর্টালে এটাও প্রকাশ পেয়েছে-কোথায়-কোথায় গুপ্ত কারাগার রয়েছে। একটি পোর্টালে (নাম প্রকাশ করা হল না) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-উৎপলকে গুম করার কাজটি যে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার, সেটি জানেন প্রায় সব মিডিয়া কর্মীরা। কিন্তু গুম হওয়ার ভয়ে কেউ প্রকাশ করেন না সেকথা। এর আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে পরিবেশ আইনজীবি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবুবকর সিদ্দিককে গুম করার পরে প্রবল চাপের মুখে ছেড়ে দিতে হয়। মানবাধিকার কর্মী ফরহাদ মযহারকে অপহারণ এবং পরে দেছে দেয়ার ঘটনার জন্য সবাই সন্দেহের আঙ্গুল তুলেছিল র্যাবের দিকে। এই অপহরণের ঘটনাও রহস্যাবৃত। সর্বশেষে গুম তালিকায় যুক্ত হয়েছেন কুয়েত ও ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।
একাধিক ওয়েব ও পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
বাংলাদেশের প্রায় সব গুমগুলির সঙ্গে ডিজিএফআই, র্যাব, ও গোয়েন্দা পুলিশ জড়িত। তাদের নিজস্ব গোপন কারাগারে শত শত গুম হওয়া ব্যক্তিরা আটক আছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, মূলত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে এসব আটকের জন্য বাহিনীগুলোকে ব্লাঙ্ক চেক দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বাহিনীর একাধিক গুম টিম আছে। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে এসব অপহরণ ও গুম করলেও বাহিনীগুলো বহু ক্ষেত্রে জিম্মি নাটক করে মোটা অংকের দাও মেরে থাকে। আবার চুক্তিতে প্রচুর অর্থ নিয়ে প্রতিপক্ষ নিধন করার কাজ করে। এমন ঘটনা ঘটাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত ফাঁস হয়ে যায় নারায়গঞ্জের-৭ মার্ডারের ঘটনা, যেখানে আওয়ামী লীগের ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই র্যাবের সিও লেঃকর্নেল সাঈদ তারেক, মেজর আরিফ ও লেঃ রানাসহ প্রায় ত্রিশ জনের র্যাব ফেঁসে যায়।সম্প্রতি কক্সবাজারে অপহরণ করে টাকা আদায়ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ডিবি টিম।
র্যাবে গুমের ঘটনা ও পদ্ধতি নিয়ে গোপনে সংগ্রহ করা একটি প্রতিবেদন কিছু দিন আগে প্রকাশ করেছিল সুইডিস রেডিও। সেখান থেকে জানা যায়, ঢাকার কচুক্ষেতে ডিজিএফআই সদর দফরের বিভিন্ন তলায় এবং মাটির তলার শত শত সেলে, পুরাতন ডিজিএফআই অফিসের উপরে ও নীচের সেলে, কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটির কয়েকটি ইগলু বিল্ডিংয়ে মাটির উপরে এবং নীচের ভবনে শত শত বন্দী আটকে রাখা হয়েছে। উত্তরায় র্যাবের-১ সদর দফরের মাটির তলায় র্যাবের সেলে গুম হওয়া অগণিত হত্যভাগ্যরা আটক রয়েছে। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বহু সেফ হাউজ তৈরী করেছিল ওয়ান-ইলাভেন পরবর্তী সরকার। ঐ সব ভবনেও বহুজন আটক আছে। বাংলাদেশের সীমান্তর্তী ভারতের এলাকা পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এলাকার অনেকগুলো কারাগার ও সংশোধনাগারেও পাঠানো হয়েছে বেশকিছু বন্দীকে।ওয়েবে প্রকাশিত এই তথ্য কতটা সত্যি-এর সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কেউ কথা বলেন না। বা তাদের প্রশ্ন করার সাহসও দেখান না কেউ। কিন্তু গুপ্ত কারাগার নিয়ে জনমনে ব্যাপক জিজ্ঞাসা রয়েছে।
বিগত দিনের অপহরণ ও গুমের পরিসংখ্যান তুলে ঐ পোর্টালের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঢাকা মহানগর বিএনপি সহসভাপতি কমিশনার চৌধুরী আলম (২০১০ সালের ২৫ জুন) এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে (২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল) গুম ছিল বড় ঘটনা। ঐ দু‘টি ঘটনা ঘটায় র্যাব। পরে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্টান্ডিং কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদকে (২০১৫ সালের ১০ মার্চ) উত্তরা থেকে অপহরণ করে র্যাব, প্রায় দু’মাস গুম করে রাখার পরে তাকে ছেড়ে দেয় ভারতের শিলংয়ে। সেখানে তিনি এখন মামলার জালে আটকে আছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিকদের জনপ্রিয় নেতা আমিনুল ইসলামের লাশ পাওয়া যায় ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল, এর কয়েক দিন আগে তাকে অপহরণ করে র্যাব। ২০১৩ সালের নভেম্বর/ডিসেম্বরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন থানার ছাত্রদলের সভাপতি, সম্পাদক, বা গুরুত্বপূর্ণ নেতা অপহৃত হন। তাদের সংখ্যা প্রায় ৩০ জনের মত। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভয় দেখানোর জন্য এই অপহরণের ঘটনা বলে দাবি করা হয় রিপোর্টে। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র (রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার) আব্দুল্লাহেল আযমী আযমী, যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিষ্টার আরমান এবং যুদ্ধাপরাধী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি পুত্র হুমাম কাদের চৌধুরীর অপহরণও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাজ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ৫৪০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৫৫ জন ছিল এবং ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে ৯৭ জনে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪৫ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৩৪৭ জনকে এখনো পাওয়া যায়নি। এদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবে অন্য একাধিক সূত্রের মতে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন দুই শ’র বেশি মানুষ। তারা কোথায় আছেন বা আদৌ বেঁচে আছেন কি-না সেটাও জানেন না পরিবারের সদস্যরা।
ভাগ্যগুণে যারা গুম থেকে ফেরত এসেছেন, এমন দু’একজনের পরিবারের সদস্যরা তাকে কী ধরনের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল, শুধু তার বর্ণনা দেন। তারা জানান যে, ছেড়ে দেওয়ার সময় তাকে এই বলে শাসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কাউকে কিছু বললে পরে আর কোনো খোঁজ মিলবে না। ফলে সে যে জীবিত ফিরে এসেছে, তাতেই তারা খুশি। বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতেও রাজি নন।