দেশব্যাপী চলমান রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গি’ তৎপরতা হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে চলছে সিডি ও ডিভিডিসহ তথ্যচিত্র নির্মাণকাজ। তথ্যচিত্র তৈরি হলে তা বিদেশী দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও সংস্থায় সরবরাহ করা হবে। লাগাতার অবরোধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে জাতিসঙ্ঘসহ বিদেশীদের আনুকূল্য পেতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে দেশব্যাপী চলা সহিংসতার ভিডিওচিত্র নির্মাণ করে একইভাবে বিদেশী দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাসহ সারা দেশে মাঠ নেতাদের কাছে সরবরাহ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সূত্রগুলো জানায়, সংলাপ ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের দাবিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিদিনই ভাঙচুর, জ্বালাও, পোড়াও, ককটেল, বোমা হামলাসহ হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ব্যাপক ধরপাকড়ের পরও এসব থামানো যাচ্ছে না। বিদেশী দূতাবাস, সরকারের মন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আদালতপাড়া ও ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িসহ ককটেল বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় জাতিসঙ্ঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পরিস্থিতির উত্তরণে অবিলম্বে সরকারবিরোধীদের সাথে সংলাপে বসারও তাগিদ দিচ্ছেন কেউ কেউ।
এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে চলা এসব ঘটনাকে ‘জঙ্গি’ কার্যক্রম হিসেবে উপস্থাপন করে বিদেশীদের আনুকূল্য লাভ করতে চায় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বিএনপি জোটের চলমান অবরোধকে কেন্দ্র করে ঘটা এসব কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর জন্য তিনি বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করে তাকে জঙ্গিদের নেত্রী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। নাশকতা দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও বিভিন্ন ফোরামে একই সুরে বক্তব্য রাখছেন। সর্বশেষ বিএনপিকে আইএস ও আলকায়েদার মতো দমন করা হবে জানিয়ে রোববার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, আইএস ও আলকায়েদার সাথে যেমন আলোচনা না করে তাদের নির্মূল করা হয় সেই রকম বিএনপিকেও নির্মূল করা হবে। তিনি বলেন, লাদেন ও আইএসের সাথে পশ্চিমারা কোনো আলোচনায় না বসে বরং দমন করেছে। তাই বিএনপি জোটের এসব জঙ্গি কার্যক্রমও কঠোর হাতে দমন করা হবে।
এর আগে আওয়ামী লীগের এক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘নিষিদ্ধ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মতো বিএনপিকেও অবৈধ ঘোষণা করা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত’।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং সম্প্রতি দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা চাপের মুখে রয়েছে সরকার। অন্য দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপি জোটের প্রতি সহানুভূতিও বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সহিংসতাকে জঙ্গি কার্যক্রম এবং বিএনপিকে একটি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
পাশাপাশি সারা দেশে ঘটে যাওয়া নানা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ভিডিও সিডি, ডিভিডি ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
একজন যুগ্ম সচিবের তদারকিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে। দলের পক্ষ থেকেও বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে বলে জানায় সূত্রগুলো। এরই অংশ হিসেবে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত বিদেশী কূটনীতিকদের বৈঠকেও চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে জঙ্গি কার্যক্রম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
সরকার কঠোর হাতে নাশকতামূলক এসব কর্মকাণ্ড দমন করবে বলেও জানানো হয় কূটনীতিকদের। এ ব্যাপারে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে যাতে কোনো ধরনের ভুল বার্তা না পৌঁছে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের সহযোগিতাও কামনা করা হয়।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জঙ্গিদের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে এ সরকারের ওপর নাখোশ হয়ে থাকা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো জঙ্গিদের ব্যাপারে আরো ‘সিরিয়াস’। তাই অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মতো বিএনপিকেও একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন করা গেলে আন্তর্জাতিক মহলও সরকারের পাশে থাকবে। আর ‘জঙ্গি’ ও ‘সন্ত্রাস’ দমনের নামে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে সরকার আরো কঠোর হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো ধরনের কথা বলবে না। এতে সরকারের ভবিষ্যৎ পথ চলা আরো সহজ হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গাড়িতে পেট্রল বোমা মেরে নিরীহ ও সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে জনমনে ভীতির সঞ্চার করছে। দেশবাসীসহ সারা বিশ্ব জঙ্গিদের ব্যাপারে সজাগ রয়েছে। তাই তাদেরকে জঙ্গিদের মতো আরো কঠোর হাতে দমন করা হবে।