বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্কের অন্ত নেই। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্পেস একেবারে সীমিত করে আনা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় খুন, গুম, গুলি ও নজিরবিহীন দমননীতির মাধ্যমে কার্যত একদলীয় শাসন প্রবর্তন করা হয়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলবাজির মুখে ভেঙে পড়ছে। অন্য দিকে সরকারি দল মনে করছে, আগে দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিরোধী পক্ষ আন্দোলনের নামে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে এবং জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থা অনুসরণ করছে। গণতন্ত্রে এ অবস্থার মোকাবেলা করা যায় না। ফলে রাষ্ট্র যা করছে তা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এ নিরাপত্তা যখন নিশ্চিত হবে তখন গণতান্ত্রিক চর্চা আবার অবারিত করা হবে।
আসলেই বাংলাদেশে কী হচ্ছে? এখানে কি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কবর রচিত হচ্ছে। সূচিত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সর্বাত্মকবাদী শাসন?
গণতন্ত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ সরকার জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়। রাষ্ট্র কারা শাসন করবে তা নির্ধারণ করে জনগণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নীতিগুলো কার্যকর হয়। একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে সরকারকে আবার জনগণের মতামতের মুখোমুখি হতে হয়। জনগণ চাইলে সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে, না চাইলে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে বহু মত ও বহু দল সক্রিয় থাকে। এক দল অন্য দলের প্রতি থাকে সহিষ্ণু এবং তারা সহাবস্থান বজায় রাখে। তারা একমত হয় যে, অনেক বিষয়ে দ্বিমতের মধ্যেও একই সমাজে পাশাপাশি সহাবস্থান করবে। গণতান্ত্রিক সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ নির্বাহি, বিচার ও আইন বিভাগ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যম সমাজে যা কিছু ঘটছে তার দর্পণ হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রের আইনসভা গঠিত হয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে গঠিত হয় সরকার। এই সরকার রাষ্ট্রের দলনিরপেক্ষ পেশাদার আমলাতন্ত্রকে দিয়ে রাজনৈতিক নীতিনির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করে। আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার পরিচালনা করলেও প্রশাসনিক কাঠামো শাসক দলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে থাকে মুক্ত। বিচার বিভাগ সাংবিধানিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথকভাবে বিচারিক দায়িত্ব পালন করে। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তাবনা কার্যকর হয়, তবে এটি একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রয়োগ হয়।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের সব দেশে একই নির্বাচনব্যবস্থা এবং একই সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, এমনটি নয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে রাষ্ট্রপ্রতি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এবং মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির কাছেই প্রাথমিকভাবে দায়বদ্ধ থাকে; সেখানে যুক্তরাজ্যে সরকার হয় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। এই ধারা অনুসরণকারী অনেক দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রচলিত আছে। সেখানে রাজা বা রানী রাষ্ট্রপ্রধান। অন্য দিকে যেসব দেশে রাজতন্ত্র চালু নেই, সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় ব্যবস্থায় তিনি ক্ষমতাচর্চার প্রতীক হলেও ক্ষমতা কার্যকর করে মন্ত্রিপরিষদ। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কাজ করেন।
সব গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনব্যবস্থাও অভিন্ন নয়। ব্রিটিশ ধারার দেশগুলোতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি সরাসরি নির্বাচিত বলে গণ্য হন। অন্য দিকে অন্য কয়েকটি দেশে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে তিনি নির্বাচিত বলে গণ্য হন না। সে ক্ষেত্রে প্রথমবার বহু প্রার্থীর নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর কেউ ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় ভোট গ্রহণ হয়। এটি সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতি উভয়ের নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে। এ ব্যবস্থায় একটি রাজ্যে যে দল অধিক ভোট পায় সে দল সে রাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ জয় করে নেয়। একটি রাজ্য ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা চালু আছে। এর ফলে পপুলার ভোট কম পেয়েও একজনের আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব। জুনিয়র জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রথমবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটে।
কিছু কিছু গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় আনুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশে সরাসরি দলভিত্তিক নির্বাচন হয় এবং যে দল যত সংখ্যক ভোট পায়, তার অনুপাতে তাদের আগে থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমাকৃত তালিকা থেকে সংসদ সদস্য বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আবার কয়েকটি দেশে প্রার্থীভিত্তিক নির্বাচন হয় এবং প্রার্থীদের ভোট যোগ করে দলীয় আসন বণ্টন করা হয়। যারা সর্বোচ্চ ভোট পান, তারা দলের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য হন।
ওপরে যে সব ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ হলে সেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। একই সাথে ক্ষমতার পৃথকীকরণ বহু মত ও বহু দলের সক্রিয়তাকেও গণতান্ত্রিক সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেয়া হয়। গণতান্ত্রিক সমাজ মূলত পরিচালিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠের জীবন-সম্পদ এবং মতের নিরাপত্তা বিধান হয় সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ফলে কার্যকর কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে সংখ্যালঘুরা জুলুম-নির্যাতন অথবা নির্মূলকরণ অভিযানের মুখে পড়তে পারে না।
বাংলাদেশে কী হচ্ছে?
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের যে ঘোষণাপত্র ছিল, তার প্রধান অঙ্গীকার ছিল শোষণমুক্ত ন্যায়বিচার-ভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন। ১৯৭২ সালে সংবিধানের এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের শাসনপ্রক্রিয়া প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল করার পর এ ব্যবস্থায় প্রথম ব্যত্যয় হয়। এরপর সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার আবার বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করে। বহুদলীয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাসীন হলেও একপর্যায়ে এ ব্যবস্থা হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে।
১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক ধারার সূত্রপাত হয়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ ধারা মোটামুটি কাজ করে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজের মেয়াদকে দুই বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করলে গণতান্ত্রিক ধারা আবার ব্যাহত হয়। এরপর ২০০৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট আবার ক্ষমতায় আসে। এ সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে মোটামুটি গ্রহণ করে নেয়া হয়। কিন্তু এ মেয়াদে এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা তুলে দিয়ে আবার ১৯৯০ সাল-পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এতে সৃষ্টি হয় নতুন রাজনৈতিক সঙ্কট। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার দাবিতে ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। সরকার তার প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। যেখানে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৪টি আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ভোট ছাড়া। এরপর যে সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রয়েছে সে সরকারের বৈধতা বড় রকমের সঙ্কটে পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি অংশগ্রহণমূলক মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের জন্য চাপ দেয়। সরকার প্রতিবেশী ভারতের সমর্থনপুষ্ট হয়ে একতরফাভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় মনোযোগী হয়। এতে রাষ্ট্রের কতগুলো বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এক.
বহুদলীয় রাজনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ : নতুন ব্যবস্থায় সরকার দেশের বহুদলীয় রাজনীতির যে গতানুগতিক চর্চা রয়েছে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। বিরোধী দল তাদের দাবি আদায়ের জন্য যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে, সেসব কর্মসূচি গণতান্ত্রিক রীতিনীতিসম্মত হলেও তা পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাভাবিক সভা সমাবেশ, সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং দলীয় কার্যালয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশে আইনিভাবে বহুদলীয় রাজনীতি সক্রিয় থাকলেও কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে প্রশাসনিক ক্ষমতার মাধ্যমে।
দুই.
গণতান্ত্রিক স্পেস সীমিতকরণ : দেশে সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন হচ্ছে, তাতে আনুষ্ঠানিকতা ঠিক থাকলেও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র চর্চার জন্য যে সমতল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে, তা পাচ্ছে না বাংলাদেশে। এর মাধ্যমে রাজনীতিকে শাসক দলের জন্য কার্যত একচ্ছত্র করে ফেলা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা মুক্তভাবে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে; যা সম্ভব হচ্ছে না বিরোধী দলের জন্য। এর মাধ্যমে বিরোধী মত সঙ্কুচিত হচ্ছে, গণতন্ত্রচর্চার আওতা সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
তিন.
সহিংসতার বিস্তার : মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে বহু মত ও পথের লালন করা হয় বলে সেখানে সহিংসতার অবকাশ থাকে না। কিন্তু বর্তমানে সরকার পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার ফলে সহিংসতাকে উসকে দেয়া হচ্ছে। গুম, খুন, দেখামাত্র গুলি, নির্বিচারে লাঠিচার্জ, এসব কিছুর সাথে জড়িত করা হচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীকে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করা হচ্ছে না। সরকারের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে এ ক্ষেত্রে আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য উৎসাহিত করে তাদের দায়মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। এর ফলে রাষ্ট্রের সর্বপর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৭২ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত কিছু সময় বাদ দেয়া হলে বাংলাদেশের বর্তমান শাসনামলে যতটা সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে তা অতীতে প্রত্যক্ষ করা যায়নি।
চার.
প্রশাসনকে দলীয়করণ : গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যখন বিকৃতি ঢুকে পড়ে তখন জনপ্রশাসন পুলিশসহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোতে দলীয়করণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনী এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়ার সময় দলীয় মনোভাবের লোকদের বাছাই করা হচ্ছে নানা কৌশলে। পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলীয় মনোভাবের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইউনিয়নপর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনযন্ত্রে রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে মামলা দায়ের ও মামলার বিচার হচ্ছে। সব কিছুর ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তেমনটি অতীতে কখনো দেখা যায়নি।
পাঁচ.
নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা : বিকৃত গণতান্ত্রিক শাসনের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো বিচারব্যবস্থার ওপর সর্বাত্মক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের নিম্ন আদালতে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ হন আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ এবং প্রধান বিচারপতির সম্মতিক্রমে। বাস্তবে উচ্চ আদালতে যেসব বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবার নিয়োগ কার্যকর হয়েছে সরকারের ইচ্ছায়। নিম্ন আদালতে যেখানে বিচারক হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, সেখানে সরকারের ইচ্ছায় উচ্চতর আদালতে বিচারপতি হওয়ার পরে অ্যাকাডেমিক জীবনের সব ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণী থাকলেও কোনো বাধা নেই। এ ধরনের যোগ্যতা নিয়ে প্রধান বিচারপতি হওয়ার রেকর্ডও সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। বিচারক নিয়োগব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতা উচ্চতর আদালতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে প্রবল করার সুযোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে এ ক্ষেত্রে অবস্থার সর্বোচ্চপর্যায়ের অবনতি ঘটেছে।
ছয়.
সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো নিয়ন্ত্রণ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিকৃতি সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ দাঁড়ায় কোনো দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পর যদি দলের স্বার্থকে সামনে রেখে ইচ্ছামতো সংবিধান সংশোধন ও আইনি কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে আসে। তা ছিল আওয়ামী লীগের ধ্যানধারণা-নির্ভর। এতে জাতীয় মতামত এবং স্বার্থের প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ সংসদ এবং এর পরবর্তী সংসদে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে তার অনেকগুলোই তৈরি করা হয়েছে এবং তাতে পরিবর্তন আনা হয়েছে সব কিছুতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য দলীয় স্বার্থে। আইসিটি আইনটি এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
সাত.
নির্বাচনব্যবস্থার বিকৃতি : বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়া। বিচারব্যবস্থার ওপর যেমন এখন সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সর্বাত্মকভাবে দেখা যাচ্ছে। একই ভাবে প্রবল হয়ে উঠছে নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব বলয় থেকে বাছাই করে। নির্বাচন কমিশনের সচিবালয় সাজানো হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক অনুগত কর্মকর্তাদের দিয়ে। এর ফলে জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক নির্দেশনায় কাজ করতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সর্বাত্বক চেষ্টা করেছে এই কমিশন।
বিশ্বাসযোগ্য পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী যেখানে এ নির্বাচনে ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি ভোট প্রদত্ত হয়নি, সেখানে নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে বলে দেখিয়েছে। এর পরে চার দফার উপজেলা নির্বাচনে প্রথম দুই দফা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা হলে এতে সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে হেরে যায়। এরপর শেষের দুই দফা নির্বাচনকে নির্বাচন কমিশনের পরোক্ষ সহযোগিতায় ভোট ডাকাতির নির্বাচনে পরিণত করা হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুরের নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সদ্যসমাপ্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচনে পরিণত করা হয়। এর মাধ্যমে কার্যত বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের যে ব্যবস্থা গণতন্ত্রে থাকে তা আর কার্যকর থাকবে না।
আট.
দুই ধরনের নাগরিক সৃষ্টি: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের চোখে সব নাগরিক সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দল-মত নির্বিশেষে সব নাগরিক আইনের চোখে সমব্যবহার পাচ্ছে না। যেকোনো ঘটনা ঘটলে বিরোধী মতের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থায় তাদের শাস্তিও হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য যখন যে ধরনের প্রয়োজন আইন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার সমর্থক এক শ্রেণীর এলিট নাগরিক তৈরি হচ্ছে, যারা আইনের ঊর্ধ্বে মর্যাদা পাচ্ছে। অন্য দিকে আরেকটি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক গোষ্ঠী সৃষ্টি হচ্ছে, যারা আইনের আশ্রয়প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । এ পরিস্থিতি সমাজে এমন এক বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা এক সময় ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় বিদেশী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে এখন এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যাতে গণতন্ত্রের গন্তব্য সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না। অদূরভবিষ্যতে অন্তর্বর্তীকালীন কোনো ব্যবস্থার অধীনে অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে উত্তর কোরিয়া, কিউবা, সিরিয়া অথবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে ধরনের সর্বাত্মকবাদী শাসন রয়েছে তার প্রবর্তন ঘটবে বাংলাদেশে। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিরোধ ক্রমাগতভাবে হয়ে পড়তে পারে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী; যেটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লক্ষ করা যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের একটি বিখ্যাত সংজ্ঞা দিয়েছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতার স্থপতি আব্রাহাম লিংকন। তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্র হলো, Of the People, By the People, For the People… । বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এ সংজ্ঞা যেন এখন পাল্টে গেছে। এখানে গণতন্ত্র হয়েছে, Of the Party, By the Party, For the Party!!! আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে বললে দাঁড়ায়, Of the Family, By The Family, For the Family. কোন এক ব্লগে একটি পদ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন কেমন তা প্রকাশ করা হয়েছিল।
সেটি ছিল এ রকম
গণতন্ত্র মানে আত্মজার ক্ষমতায় আরোহণ
গণতন্ত্র মানে স্ত্রী পুত্রের গদি দখল
গণতন্ত্র মানে ক্ষমতাসীনের সন্ত্রাস আর লুটপাট
গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবারের চোটপাট
গণতন্ত্র মানে স্বৈরাচারের মুখে বিজয়ের হাসি
গণতন্ত্র মানে নিরীহ জনতার স্বাধীনতায় ফাঁসি
গণতন্ত্র মানে হল দখল, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি
গণতন্ত্র মানে ছাত্রদের কলম ছেড়ে বন্দুক আর বারুদবাজি
গণতন্ত্র মানে হারিয়ে ফেলা বাকস্বাধীনতা
গণতন্ত্র মানে ক্ষমতাসীনের শুধুই পদলেহিতা।