দেশের প্রায় সবক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। স্বাস্থ্যসেবা খাতেও এর প্রভাব লক্ষনীয়। দুর্নীতি দমনে আমরা জাতীয়ভাবে ব্যর্থতার পরিচয়ই দিচ্ছি। দুর্নীতি যে বেড়েই চলেছে, সে জন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচক কিংবা দুর্নীতিতে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দেখে লাভ নেই, প্রতিদিন দেশের মানুষ দুর্নীতির কবলে পড়ার দুর্ভোগের অভিজ্ঞতার আলোকেই তা আঁচ করতে পারে। দুর্নীতি এখন সব খাতে ক্রমেই জোরালো ও জটিল রূপ ধারণ করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যা থেকে দেশের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম কতটা হুমকির মুখে তা সহজেই অনুমেয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই কেনা হয়েছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। ‘এ’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতির মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতি। কখনো কখনো দেশে থেকেই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কোনো নামকরা বিদেশি কোম্পানির। ফরিদপুর মেডিকেলে যন্ত্রপাতির মূল মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। ১৭৫ কেটি টাকার নিম্ন মানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্যও। শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেলে আড়াইশ’ কোটি টাকা। রংপুর মেডিকেল কলেজে ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ৪ কোটি টাকার সার্জিক্যাল ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এছাড়া হাসপাতালটির বিরুদ্ধে আরও ২০ কোটি টাকা গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চাহিদাপত্র ছাড়াই ভুয়া বিল দাখিল করে পিএসিএস সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির নামে ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়। সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার, ফরিদপুর মেডিকেলে কলেজে অন্তত ৩০ কোটি টাকা, নোয়াখালী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ১৫ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যার হাসপাতালের ১৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ঢাকা মেডিকেলে কলেজে ২১ কোটি ৭০ লাখ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা, মৌলভীবাজার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালে ১৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও তা অব্যবহৃতই রয়েছে। কক্সবাজার মেডিকেলে ভুয়া যন্ত্রপাতির লেবেল লাগিয়ে সাড়ে ৪৮ কোটি টাকার মধ্যে ৩৭ কোটি ৪৮ কোটি টাকাই আত্মসাৎ করা হয়।
এমনকি মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের সংকটেও থেমে নেই স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসাসামগ্রী (ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, পিপিই, টেস্টিং কিট/ওষুধপত্র) কেনাকাটায় অন্তত ২২ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চিকিৎসা দিতে গিয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত আড়াই শতাধিক চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে এন-৯৫ মাস্ক কেনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জন্ম দিয়েছে নতুন কেলেঙ্কারি। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুকূলে অর্থ বিভাগ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি বিবরণী ও ব্যয় পরিকল্পনা অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে অধিদফতর। এর বাইরে বাকি ১৫০ কোটি টাকা খরচের হিসাব অবশ্য পাঠায়নি তারা। সেখানে ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র, পিপিই, কিট, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কেনার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। আর ১০০ কোটি টাকা ভবিষ্যৎ ব্যয়ের পরিকল্পনা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ওই বিবরণীতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা, যা রীতিমতো এক গোঁজামিলের আশ্রয় বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ তো গেল অর্থ ব্যয় আর কেনাকাটা সংক্রান্ত অয়িনম-দুর্নীতি আর হিসাবে গোঁজামিলের কথা। এদিকে এন-৯৫ মাস্ক কেনাতেও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বিদেশ থেকে আমদানির কথা বলে দেশীয় কোম্পানি জেএমআই থেকে কেনা হয়েছে এন-৯৫ মাস্ক, যা আদতে এন-৯৫ নয়। বরং সেগুলো সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভুল স্বীকার করে দায়মুক্তি চেয়েছে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত এন-৯৫ মাস্ক করোনা সেবাদানকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেখানে করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হিসেবে ঘোষিত হাসপাতালের বাইরে ঢাকা ও সারা দেশের কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে এক পিসও এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে সংক্রমণের হার প্রতিদিন বাড়ছে। আমাদের হাতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছি। শুধু কথা দিয়ে করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে চাওয়া চরম বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।