রাষ্ট্রের নীতি-কাঠামোর মধ্যে অবৈধ উপায়ে ও প্রভাব খাটিয়ে সম্পদ অর্জনের লোকজন বেড়ে গেছে। পরিবহন খাতে অবস্থা আরও প্রকট। পরিবহন খাতের গণদুর্ভোগ ও চাঁদাবাজির ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হচ্ছে এই খাতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিচরণ। যার সরাসরি শিকার হয় সাধারণ মানুষ। প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদসহ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকেরা রাজধানীর গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।গণপরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোও অনেকটা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। ফলে ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। প্রভাবশালী মালিকদের কারণে পরিবহন খাতে নৈরাজ্য কাটছেনা।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ শাহিদা তারেখ, সাংসদ নূরে আলম চৌধুরীর (লিটন) চাচাতো ভাই মনির চৌধুরী, সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ভাই মমতাজুল ইসলাম, পিরোজপুরের সাংসদ এ কে এম এ আউয়ালের ভাই, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়ার ছেলেসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। আবার কোনো কোনো মন্ত্রী-সাংসদ সরাসরি না জড়িয়ে নেপথ্যে থেকে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত আছেন।
রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে বাস চলাচলের নতুন পথ (রুট) চালুর অনুমতি মেলে না। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া বিভিন্ন সময়ে যে দু-একটি নতুন বাস রুটের অনুমতি মিলেছে, সেগুলোর জন্য বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে ঢাকা মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (মেট্রো আরটিসি) বৈঠকে চারটি নতুন পরিবহন কোম্পানি—কনক পরিবহন, প্রজাপতি পরিবহন, হিমাচল পরিবহন ও বসুমতি পরিবহনকে বাস চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এর আগে গত বছর অনুমতি পায় জাবালে নূর পরিবহন। এসব কোম্পানির মধ্যে কনক পরিবহন হলো নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই হাফিজুর রহমান খানের। এই কোম্পানির ২০টি বাস গাবতলী থেকে মিরপুর হয়ে আবদুল্লাহপুর গন্তব্যে চলার অনুমতি পায়। এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পর কনক পরিবহন মিরপুর থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত আরেকটি পথে ১৫টি বাস নামানোর অনুমতি পায়।
জাবালে নূর পরিবহনের উদ্যোক্তা অরাজনৈতিক হলেও এর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মিরপুর যুবলীগের এক নেতা। আরও আছেন মাহমুদ হোসেন নামের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের এক আত্মীয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে মাহমুদ হোসেনের শিখর পরিবহন মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ী পথে বাস চালানোর অনুমতি পায়। তখন তা উদ্বোধন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের স্ত্রী। এ ছাড়া শাজাহান খানের পরিবারের মালিকানায় ঢাকা-মাদারীপুরের পথে সার্বিক পরিবহনের বাস চলাচল করে।
প্রজাপতির মালিক আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ শাহিদা তারেখ। প্রজাপতি পরিবহনও মিরপুরের নতুন উড়ালসড়ক হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ৫০টি বাস চালানোর অনুমতি পায়। বসুমতি পরিবহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দাকার এনায়েত উল্যাহর। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক প্রভাবশালী পরিবহন নেতা। তিনি ঢাকা মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) আঞ্চলিক সদস্য। মহানগর পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন এই কমিটি মূলত কোন পথে কোন বাস চলাচল করবে, তার অনুমতি দেয়।
অভিযোগ রয়েছে, কোন পথে কত বাসের চাহিদা, সেটা না দেখেই চলাচলের অনুমতি দেয় ঢাকা মেট্রো আরটিসি। মালিকের সুবিধামতো বাসের পথ অনুমোদন করার কারণে রাজধানীর কিছু গন্তব্যে বেশি বাস চলে। আবার কিছু গন্তব্যে যাত্রীরা ঠিকভাবে বাসই পান না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিরপুর ও পল্লবী এলাকা থেকে ৪২টি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণমুখী পথগুলোতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাস চলাচল করে। পূর্ব-পশ্চিমে এ সংখ্যা অনেক কম।
একই স্থান থেকে একাধিক বাস চলার পথ অনুমোদন এবং একাধিক মালিক থাকার কারণে কার আগে কে যাত্রী তুলবে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এক কোম্পানির বাস যাত্রী তোলার সময় অন্য কোম্পানির বাস যাতে না যেতে পারে, সে জন্য রাস্তায় আড়াআড়িভাবে দাড় করিয়ে যানজটের সৃষ্টি করা হয়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ারও ঘটনা ঘটে অহরহ।
পরিবহন শ্রমিকেরা জানান, রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ বাস-মিনিবাসের গায়ে যে ক্ষত, রংচটা অবস্থা, এর মূল কারণ একই পথে একাধিক কোম্পানির বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।