পুরো নাম শামিমা নূর পাপিয়া। তবে পিউ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সেক্রেটারি তিনি। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে এর আড়ালে তিনি মূলত অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করতেন। কোনো কাজ বাগিয়ে নিতে পাঁচ তারকা হোটেলে সুন্দরী তরুণীদের পাঠিয়ে মনোরঞ্জন করতেন সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের।
তার ও তার স্বামীর ব্যবসায়িক অংশীদারদের অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য নারী সবরবরাহ করাই ছিল তার মূল কাজ। নরসিংদীতে চাঁদাবাজির জন্য তার একটি ক্যাডার বাহিনী আছে। স্বামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবৈধ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে সে অল্প সময়ে নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক হয়েছে। গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল সে দীর্ঘদিন ধরে। তিন মাসে তিনি সেই হোটেলেই বিল দিয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে সে প্রতিদিন বিল দিত প্রায় আড়াই লাখ টাকা। অথচ বৈধভাবে তার বার্ষিক আয় মাত্র ১৯ লাখ টাকা। তার এই বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগানদাতা আওয়ামী লীগেরই বড় বড় নেতারা।
হঠাৎ করেই নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে যান শামীমা নূর পাপিয়া। এরপর আর তাকে পিছু তাকাতে হয়নি। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে স্বল্প সময়ে হয়ে যান বিত্ত-বৈভবের মালিক। নানা কৌশলে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতেন। বড় নেতাদের খুশি করতে পাপিয়ার কাছ থেকে সুন্দরী তরুণী সংগ্রহ করত নেতারা।
বহু নেতার ফোন কেন্দ্রীয় নেতারা না ধরলেও পাপিয়াকে নিজ থেকেই ফোন করতেন তারা। এভাবে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন পাপিয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে পাপিয়া পাপ ধরা পরার পর তার পৃষ্ঠপোষকরা তার দায় নিতে নারাজ। গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাপিয়ার নানা অপকীর্তি প্রকাশ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে যুব মহিলা লীগের নেতা-নেত্রীরা একে অন্যকে দোষারোপ করতে শুরু করে।
তবে কারা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, বিভিন্ন কমিটিতে বড় পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং কারাই বা তার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম বলেছেন, যাদের সঙ্গে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে। মূলত এসব নেতাই পাপিয়ার উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন এমপির সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে পাপিয়া।
রাজনীতিতে উত্থানের নিয়ামক হিসেবে দুজন প্রভাবশালী নেত্রীর নাম বলেছেন পাপিয়া। পরে তারাও নিয়মিত পাপিয়ার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন। তাদের একজন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক এমপি। পাপিয়ার সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসাও রয়েছে। ওই নেত্রীর মাধ্যমেই বিস্তৃত হতে থাকে তার বলয়। অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ান, গড়ে তোলেন এক বিশাল সিন্ডিকেট। এছাড়াও পাপিয়া বলেছেন, বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য অনেক নেতাই তরুণীর জোগান দিতে পাপিয়ার সহায়তা চাইতেন।
ওই নেতাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অনেক ছবিই পাপিয়া কৌশলে তুলে রেখেছেন। ওইসব ছবি দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করতেন পাপিয়া। রাজনীতির আড়ালে এটি ছিল তার মূল ব্যবসা। ওইসব ছবি ব্যবহার করে সমাজের উঁচু স্তরের লোকদের ব্ল্যাকমেইল করা ছাড়াও বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ বাণিজ্য করতেন পাপিয়া।
অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় গ্রেফতার নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে কীট আখ্যা দিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল। তিনি বলেছেন, পাপিয়াদের অপকর্মের দায় যুব মহিলা লীগ নেবে না। এমনকি পাপিয়ার কঠোর শাস্তি দাবিও করেছেন অপু উকিল। অথচ তাকে পদ দেয়ার ক্ষেত্রে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের সমর্থন ছিল বলে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা জানিয়েছেন। অপু উকিল তা অস্বীকার করে বলেন, নরসিংদী আওয়ামী লীগের নেতাদের সুপারিশে পাপিয়াকে পদ দেয়া হয়েছিল। পাপিয়ার অপকীর্তির বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেন অপু উকিল।
যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে পাপিয়ার সখ্যের বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা, সমালোচনা হয়। পাপিয়ার নানা কাজে তুহিনের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে তুহিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, পাপিয়ার সঙ্গে তার সাংগঠনিক সম্পর্কের বাইরে কিছু ছিল না।
পাপিয়ার পাপকাজ সামনে আসার পর বড় বড় নেতারা তাকে চিনেও না চেনার ভাণ করলেও পাপিয়ার এই পাপী সাম্রাজ্য তাদের সহযোগীতা ছাড়া একদিনে গড়ে ওঠেনি তাতো কাচের মতোই স্বচ্ছ।