বিশেষ করলাম:- নেই বর্গী, নেই ইংরেজ, নেই পাকিস্তানী হানাদার
আজও তবু কেন আমার মনে শূন্যতা আর হাহাকার ?
আজও তবু কি লাখো শহীদের রক্ত যাবে বৃথা ?
আজ তবে কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা?
কি দেখার কথা, কি দেখছি
কি শোনার কথা, কি শুনছি
কি ভাবার কথা, কি ভাবছি
কি বলার কথা, কি বলছি
আট চল্লিশ বছরে এসেও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।
-: হায়দার হোসেনের গান :-
১/ “স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, রক্ষা করা আরো কঠিন”…এই গুরুত্বপূর্ণ আপ্তবাক্যটি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতীব সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে অসম্ভব ত্যাগ, তিতিক্ষা, অনেকের অপরিসীম সাহস এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। বিজয়ের ৪৮’বছরে এসে সেই স্বাধীনতার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গণতন্ত্রসহ অনেক মূল্যবোধই ধ্বংস করে ফেলেছি। অবশিষ্ট যা আছে তাও প্রায় ধ্বংসের পথে। বড়ই দুর্ভাগ্যজনক হলো কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও যে রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই স্বাধীনতাকে পুনরায় বিসর্জন দেয়ার সকল আয়োজন গত এক যুগ ধরেই চলছে।
২/ বাংলাদেশের জনগণ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র জনগোষ্ঠীই শুধু নয়, সবচেয়ে নিরুপায়ও। স্বাধীনতার সুযোগে আওয়ামী লীগ প্রথমে ক্ষমতায় এসেছিল; নইলে তার ক্ষমতায় আসা হয়তো কখনো ঘটতো না। পৌরানিক জনপ্রিয়তা হারাতে আওয়ামী লীগ সময় নষ্ট করে নি; স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের এক বছরে এটি জনবিরোধী দলরূপে দেখা দিয়েছিলো, এবং পরের দু-বছরে দলটি জনগণকে এমনভাবে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল, যার তুলনা মেলে না। যাঁকে লাখ লাখ বাঙালী প্রাণের বিনিময়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে সব ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তবুও তিনি তৃপ্ত হননি, তাঁর দরকার হয়েছিল বিশেষ ক্ষমতা। তিনি হতে চেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ শক্তিমান। ১৯৭৫ এর ২৫’জানুয়ারী তাঁরই হাতে নিহত হয়, তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭২- এ প্রণীত অসামান্য সংবিধান; বাংলাদেশ গণতন্ত্র থেকে পদার্পন করে চরম একনায়কতন্ত্রে। ঐ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭৫ এর ১৫’আগষ্টের রাতে ঘাতকেরা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। আর ঐদিনেই তাঁর দলের নেতারা রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হয়ে দেখিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ কতো টা কৃতঘ্ন হতে পারে।
৩/ বিগত ৪৮’বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের যে দুটি বড় গণতান্ত্রিক অর্জন সেই দুটিই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পথিকৃত, বিএনপির বর্তমান চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মাধ্যমে। এর প্রথমটি হলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬’এপ্রিল জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ‘বাকশাল প্রথা’ বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। অন্যদিকে একনিষ্ঠ গণতান্ত্রিক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে বিরতিহীন সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯০ এর ৬’ডিসেম্বর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জনগণ তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করে। বস্তুত ৪৮’বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে জিয়া পরিবারের অবদান অপরিসীম এবং অদ্বিতীয়। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক অর্জনগুলোকে ধ্বংস করেছে। জিয়া পরিবার এবং তাদের দল বিএনপির মাধ্যমে আবারও তা অর্জিত হয়েছে। এখনো বর্তমান ক্ষমতাসীন ‘ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ’ দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্র উদ্ধারে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
৪/ অপ্রিয় জিনিষের আয়ু মাঝে মাঝে, সম্ভবত অধিকাংশ সময়, দীর্ঘ হয়ে থাকে। বর্তমান ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার এ- বেদনাদায়ক সত্যটিকে চমৎকারভাবে প্রমাণ করে যাচ্ছে। এক-এগারো সরকার, সেনাবাহিনী এবং পাশ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহযোগিতায় ২০০৮ সালের কূট-কৌশলের নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তারা এখনো ক্ষমতায় আছে। এরেই মধ্যে ২০১৪ এর ৫’জানুয়ারী ‘একদলীয় এবং বিনাভোট’ এর দশম এবং ২০১৮ এর ৩০’ডিসেম্বরের ‘মিডনাইট নির্বাচন’ নামে একাদশ নির্বাচন করে ১৮ কোটি জনগণের ভোটকে হাইজ্যাক করে ক্ষমতায় থাকার নির্লজ্জতা দেখিয়েই যাচ্ছে। জনগণের ভোটকে কুক্ষিগত করতে যেয়ে তারা সকল ধরনের প্রশাসনকে অবৈধ, অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দেশের শাসনকার্য ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত তারা বিতর্কিত করে ফেলেছে। গুম, অসততা, দুর্নীতি, পৈশাচিকতায় দেশকে ঢেকে ফেলেছে। দেশের শাসন, আইন এবং বিচার এই তিন স্তম্ভকে প্রায় ধ্বংস করে বাংলাদেশকে ‘ফেইলড এসটেট’ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতায় রাখার স্বার্থে ভারতকে অনৈতিক, বিনিময়হীন, অন্যায্য এবং মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে দেশকে প্রায় নিঃস্ব করে ফেলেছে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতার মোহে ব্যস্ত হয়ে পাশ্ববর্তী আরেক প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে পর্যন্ত কুটনীতিতে হার মেনেছে। ফলশ্রুতিতে ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা দেশের উপর চেপে বসেছে।
৫/ গত এক যুগে জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইউইই, ব্রিটেনসহ সকল উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ এবং মানবাধিকার সংস্থা সরকারকে অনেকবার সতর্ক এবং তিরস্কার করেছে একযুগ ধরে চলা তাদের অপরিমাণদর্শীতা, মানবাধিকার লংঘন এবং ভোট ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য। কিন্তু সে সতর্কতা এবং তিরস্কারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো অমানবিক এবং পৈশাচিকতার মাধ্যমে ভারতের সমর্থন নিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ এখনো ক্ষমতার দাপট অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মান এবং সম্মান দিনদিন অধঃপতিত হচ্ছে। এবছর জানুয়ারীতে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এর জরীপে ১৬৭ টি দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক কিংবা ক্রটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই; কিন্তু নাম আছে আরো ক্রটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায়। ঐ তালিকায় গণতন্ত্র এবং ক্রটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা যথাক্রমে ২০ এবং ৫৫ টি। ওই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৮৮তম। ভারত, শ্রীলংকার স্থান ৪১ ও ৭১। অন্যদিকে ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ নামে একটি জার্মান প্রতিষ্ঠানের বিশ্বের ১২৯টি দেশের গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে আরেকটি জরিপে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের নূন্যতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না”। এই রিপোর্টে ৫৮’টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১’টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০। একই অবস্থানে আছে রাশিয়াও। ২০১৫’সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭’সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সময়ে এই সমীক্ষা চালানো হয় যেসব দেশের উপর, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ৫টি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের নূন্যতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশের ক্রটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে এই রিপোর্টে।
৬/ বাঙালীর ইতিহাস যুগপৎ স্বাধীনতা পাওয়া ও হারানোর ইতিহাস। একদিকে আমরা যতোটা স্বাধীনতা পাই, একই দিনে আরেক দিকে আমরা তার অনেক বেশী স্বাধীনতা হারাই। এক দশকে আমরা যতোটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাই, অর্থাৎ রক্ত দিয়ে অর্জন করি; এক বছরেই তার কয়েক গুণ চিন্তার ও বাকস্বাধীনতা হারাই। এখন সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা, যুক্তিশীলতা ও বাকস্বাধীনতাকে ধ্বংস করা হচ্ছে যাতে আর কেউই মুক্তচিন্তার সাহস না করে। এখন খুব বেশী করে মনে হচ্ছে এবং বিশ্বাস হচ্ছে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ এবং তার দলের যেন এ দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি অপরিসীম ক্ষোভ আছে, তা নাহলে যে দেশ মাত্র দু’বছর পরে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে সে দেশটিকে শাসনে, আইনে, বিচারে এবং সম্মানে এতো লণ্ডভণ্ড এবং দেউলিয়া করার কারণ কি ???
৪৮’তম বিজয় দিবসে ৩০’লক্ষ শহীদ এবং ২’লক্ষ সম্ভ্রমহারা মাবোনের প্রতি রইলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা, সমগ্র দেশবাসীর প্রতি রইল বিজয়ের অভিনন্দন। সত্যিকার বিজয় আসবে খুব শীঘ্রই ইনশাআল্লাহ।