দশবছরে খেয়ে খেয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা আর অন্যায় সুবিধাভোগকারী সেই শ্রেনীটি চায়– তাদের এই ঘি-মাখন অব্যাহত থাকুক। আপনার নাগরিক অধিকার চুলোয় যাক কিন্তু তাদেরটা বরাদ্দ অক্ষুন্ন থাকুক।
অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখা যাচ্ছে অনলাইনে। ভোটের প্রচারণায় নেমে পড়েছেন গণমাধ্যমের নানা রুই কাতলা থেকে শুরু করে ডানকিনে পর্যন্ত। লাফঝাঁপে তারা মুখর করে তুলেছেন মিডিয়ার সকল জলাশয়। চেতনা টুপুর টাপুর করছে নির্বাচনী মওসুমে। কাকে ভোট দিলে উন্নয়নের গাড়ি হাওয়া চলবে, কাকে ভোট দিলে ঢাকার রাস্তাগুলোতে পাল উড়িয়ে নৌভ্রমন করতে পারবেন তার নসিহতে মুখরিত করে তুলছেন আপনার কর্ণকুহর। এমন ফাল্গুনী হাওয়ায় উড়ে যাবেন না। আপনার ভোটটি দেয়ার আগে একবার পেছনে ফিরে তাকান। অন্তত পেছনের একটি দশকে।
আপনার ব্যাংকের টাকা লুটের বাতাসা হয়েছে আর আপনি আমানত ফেরতের আশায় চক্কর কাটছেন। বিস্মৃত হবেন না। আপনি তাদেরই একজন যে দশ লক্ষ পরিবার শেয়ারমার্কেটে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাতে বাসায় ফেরার পথে আপনার ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছে সাদাপোষাকের ‘ভুত’। তার গুলিবিদ্ধ পেটকাটা লাশ ভেসে উঠেছে কোনো নদীর জলে কিংবা লাশই পাওয়া যায়নি। আপনি তার ছবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেই যাচ্ছেন। কিংবা আপনার বোনকে তুলে নিয়েছে সোনার ছেলের দল। নিয়মিত রাস্তাঘাটে ইভটিজিং এর শিকার হয়েছে আপনার বোন। বিশেষ দিবস উপলক্ষে রাস্তা বের হয়েছিলেন আর সোনার ছেলেরা আপনাকে উত্যক্ত করেছে। জল ছিটিয়েছে শরীরে। আপনার স্ত্রীর কাপড় টেনেছে। আপনার কন্যার শরীরে চিমটি কেটে গেছে কিন্তু আপনি অক্ষম ক্রোধে ফুঁসেছেন। কিছুই করতে পারেননি।
বিদ্যুতের প্রতিটি ইউনিট কিনেছেন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দামে। রেকর্ডব্রেকিং মেগাওয়াট উত্সবে। এরপরও লোডশেডিংয়ে আপনার জীবন জেরবার হয়েছে গ্রীষ্মকালে। বর্ষায় আপনি রাস্তা নয় – জলাবদ্ধ ‘সমুদ্র’ পাড়ি দিয়েছেন। রাতে আপনাকে গুলি করেছে না হয় পিষে মেরেছে এমপি আর ভিআইপিপুত্ররা। আপনার বেতন বাড়েনি, কিন্তু সিন্ডিকেট তোষনে বেডেছে দ্রব্যমূল্য ও পরিবহন ভাড়া। প্রতিবাদ করতে গেলেই ‘ক্ষমতাবান’ মন্ত্রীর পরিবহন শ্রমিকেরা আপনাকে ধরিয়ে দিয়েছে ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’।
ধরুন আপনার ছেলে পরীক্ষার্থী। প্রতিটা পরীক্ষায় প্রশ্ন হয়েছে ফাঁস। চোখের সামনে দিয়ে প্রশ্ন কিনে আপনার সন্তানের শ্রমকে তুড়ি মেরে ভালো ‘রেজাল্ট’ করেছে আপনার প্রতিবেশীর সন্তান।
আপনার সহপাঠিকে গেস্টরুমের বাইরে ফেলে ঠান্ডায় সারা রাত ফেলে মারা হয়েছে, ক্যালকুলেটরের জন্য মারা হয়েছে, বারান্দা থেকে ফেলে মারা হয়েছে। আপনারা রাস্তায় নেমেছিলেন কোটা সংস্কারের জন্য, মামলা আর হামলায় আপনার জীবন শেষ হয়ে গেছে। রাস্তায় এসেছিলেন নিরাপদে বাসায় ফেরার দাবীর জন্য, পিটুনি খেয়ে লুকিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে আপনি বেকার, বাজারে কোনো চাকরি নেই।
রাস্তায় বা ফুটপাতে আপনাদের চাপা দিয়েও জামিন পেয়ে গেছে হত্যাকারী। অন্যদিকে অনলাইনে ‘উহ’ করলেই মুখোমুখি হয়েছেন মামলা আর হয়রানির। আর
এই সময়গুলোতে ‘ঘি-মাখন’ চেটে গেছে একটা সুবিধাভোগী শ্রেনী। যারা আপনার নাগরিক অধিকারের কোন দাবী আদায়ে আপনাকে সমর্থন তো দেয়নি, উল্টো ধরিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগের গুন্ডাদের হাতে। বরং তাদের দেখা গেছে হাজারমেগাওয়াটের আলোকসজ্জার উৎসবে নর্তন কুর্দনরত। যখন ভেতরে ভেতরে সব ফাঁকা-ফোকলা হয়ে যাচ্ছিলো তখন তাদের দেখেছেন ‘বায়বীয় দেশপ্রেমের’ রেকর্ড বানানোর প্রোগ্রামে! অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সময় তাদের দেখা গেছে ‘বাসায় ফিরে যাও’ পোস্ট দিতে।
যদি সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হয়, যদি আপনি নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেন, আপনার ভোট কোন হাফপেন্টুল বাহিনী না দিয়ে দেয়, অথবা আপনার মৃত আত্মীয়স্বজন যদি আপনার সাথে দেখা না করে ভোট দিয়ে যায়- তবে আপনাদের বলবো না যে অমুক পক্ষের শক্তিকে ভোট দিন। কিংবা অমুক পক্ষের উন্নয়নের মহাসড়কে হাজার কিলোমিটার বেগে উঠে পড়ুন।
বলবে শুধু, একবার আপনার চোখ দুটি বন্ধ করুন। এক মুহূর্ত প্রাণভরে শ্বাস নিন। তারপর কল্পনা করুন বিগত দশটি বছর। কেমন কাটিয়েছেন আপনিও আপনার পরিবার। কী সব লোমহর্ষক দৃশ্য দেখেন। এবার নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন- ‘আমি কি ভালো ছিলাম? আমার পরিবার কি ভালো ছিলো?’ এবার সিদ্ধান্ত নিন। আপনার ভোটটি প্রয়োগ করুন।