মানবতা বিরোধী অপরাধ করায় পুলিশ পরিদর্শক আবু হাজ্জাদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটি একটি প্রাথমিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। বিভাগীয় তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রাথমিকভাবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন মর্মে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২২ তারিখের হরতালে এই পুলিশ বাহাদুর যেভাবে পিকেটার শিকার করে, দাম্ভিক শিকারীর মত শিকারের গায়ে এক ঠ্যাং তুলে দিয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়েছিলেন তাতে নিজেও ভয়ে ঘৃণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। নিজের আর ওই নির্যাতিতের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাই নি। এই বাংলাদেশ নামক জঙ্গলের এক নগন্য পশু শিকার করে তার বুকের ওপর ঠ্যাং রেখে ছবি তোলার অধিকার তো পুলিশ বাহাদুরদেরই আছে। নিজে কবে শিকার হই সেই আশংকাতে থাকা ‘আমি’ তাই পত্রিকার সংবাদে কিছুটা খুশিই হয়েছিলাম।
তারপর একটু পর্যালোচনা করার জন্য পেছনের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম।
গার্মেণ্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় এক শিশুকে পুলিশ বাহাদুরেরা অমানবিক শাসন করেছিলেন। সেই ঘটনা মিডিয়াতে ঝড় ও তুলেছিলো, তবে সেই ঝড় সংসদ পর্যন্ত পৌছে নি। বাংলাদেশের “শিশু আইন ১৯৭৪”এর ৩৪নং ধারায় বলা হয়েছে—‘যাহার হেফাজতে, দায়িত্বে বা তত্ত্বাবধানে কোন শিশু রহিয়াছে এইরূপ কোন ১৬ বছরের উপর বয়স্ক ব্যক্তি যদি অনুরূপ শিশুকে এরূপ পন্থায় আক্রমণ, উত্পীড়ন, অবহেলা,বর্জন অথবা অরক্ষিত হালে পরিত্যাগ করে অথবা করায় যা দ্বারা শিশুটির অহেতুক দুর্ভোগ হয় কিংবা তাহার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এবং তাহার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়,শরীরের কোন অঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি হয় এবং কোন মানসিক বিকৃতি ঘটে তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদে কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ সেই আইন অনুযায়ী এই দুই পুলিশ বাহদুরের কোন বিচার হয় নি?
পুলিশ বাহাদুরগণ কর্তৃক নারীর বস্ত্র হরন, পদদলন এবং নিপীড়নের অনেক ঘটনা মিডিয়াতে এসেছে। কিছু কিছু ঘটনায় সুশীল সমাজ সোচ্চার ও হয়েছে। ফলাফল শূণ্য, বিচার হয় নি।
খোদ মিডিয়ার মানুষ অর্থাৎ এক বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিককে ঘুষি মেরে ‘আকবর’ পুলিশের জেল-জরিমানা হয়েছে বলে কোন খবর রটেনি। ঠিক তেমনি ফুটপাতের হকার বা সাধারণ মানুষের ওপর পদদলন বা নির্যাতনের কারণে পুলিশ বাহাদুরদের বিচারের মত কোন ঘটনাও ঘটেনি।
কলেজ ছাত্র লিমন RAB এর গুলিতে পা হারিয়ে পুলিশের দেয়া মিথ্যা অস্ত্র মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পুলিশ বাহাদুরেরা মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বুক ফুলিয়ে চিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রকে যে পুলিশ বাহাদুর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করেছিলেন, তিনিও বহাল তবিয়তেই আছেন। মাঝখান থেকে কাদের কাঁদছে ডাকাতির মামলায়। এই দু’টি ঘটনায় মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ অনেক হইচই করেছে। কাজের কাজ কিছুই হয় নি। অপরাধীর শাস্তি হয় নি।
এমন কি দেশের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহম্মদ যখন পুলিশ বাহাদুরদের পায়ের ডলায় পিষ্ট হয়েছেন তখনো কারো শাস্তি হয় নি। নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দলের চীপ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুকের উপর পুলিশের দুই বাহাদুর কর্মকর্তা যে নিপীড়ন চালিয়েছেন তা সারা বিশ্বের মিডিয়ায় সমালোচিত হয়েছে। দেশের সুশীল সমাজে বিষয়টা মোটামুটি আলোড়ন তুললেও সংসদে বসে জয়নাল আবেদীন ফারুক সাহেবের সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া ছিলো পুরোই উল্টো। উনারা সেই পুলিশ বাহাদুরদের পক্ষ নিয়েই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, “জয়নাল আবেদীন ফারুক নিজের দোষেই পিটুনি খেয়েছেন।”
বে এইবার ঘটনা ভিন্ন। ২২ তারিখের হরতালে যে ভাগ্যবান আদম সন্তান পুলিশ বাহাদুরের পদতলের শোভা বর্ধন করেছেন তার বিষয়ে সংসদ গরম হয়েছে। পুলিশকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। প্রায় তাৎক্ষনিকভাবে নিপীড়ক পুলিশ বাহাদুরের শাস্তিও হয়ে গেছে। শত বছরের প্রভু পুলিশ বাহাদুরদের এমন ভালমানুষি আচরণ যে নিজেদের স্বদিচ্ছায় হয় নি তা বলাই বাহুল্য। যারা নিজেদের মধ্যেকার ধর্ষক ও খুনিদের রক্ষা করতে পর্যন্ত পিছ পা হয় না, তারা যে রাজনৈতিক চাপেই এই সাময়িক ভাল মানুষের ছদ্মবেশ ধরেছে তা মোটামুটি নিশ্চিত।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটা হঠাৎ এমন হলো কেন? আমাদের সরকার দলীয় এমপি’রা কি তবে হঠাৎ করেই মহামানব হয়ে গেলেন? নাকি এই বিশেষ ক্ষেত্রেই উনাদের এই মহানুভবতা? কিছুদিন ধরেই সরকারের পেণ্ডুলাম অবস্থান নিয়ে খোমেনী ইহসান পরপর দু’টি লেখা লিখেছেন; শিরোনাম যথাক্রমে, “যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর গন্তব্য“ এবং “মহোদয় গবুচন্দ্রবৃন্দ! কুতকুত খেলা আর যুদ্ধাপরাধের তদন্ত এক নয়“। আজ কেন জানি এমন সুবিচার দেখেও খুশি হবার বদলে ভয় পেলাম।
Nationalist View – analysing Bangladeshi politics.
Copyright © 2020 Nationalist View – All rights reserved.