মহামতি ইমাম ইবনে আল রাজাবের একটা বাণী আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় প্রায়শই। তিনি বলেছিলেন ‘জ্ঞানের তিনটি স্তর। যে প্রথম স্তরে প্রবেশ করবে, সে অহংকারী হয়ে উঠবে, যেন সব কিছুই সে জেনে ফেলেছে । দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করার পর সে বিনয়ী হবে। আর তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করার পর সে নিজের অজ্ঞতা উপলদ্ধি করতে পারবে।’ উনি দু-এক কথায় বুঝিয়েছেন অনেক কিছুই। তিঁনি মনে হয় বোঝাতে চেয়েছিলেন- যে জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশ করবে সে ভাববে সেই সবচেয়ে জ্ঞানী, তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না; অন্য সবার জ্ঞানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা তাঁর কাছে নিত্য-নৈমত্তিক হয়ে পড়বে। যিনি জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করবেন তিনি বিনয়ী হবেন- মাথা নত করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করবেন। বুঝতে পারবেন কারো জ্ঞানকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। তিনি চেষ্টা করবেন সবার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে। আর যিনি জ্ঞানের তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করবেন তিনি উপলব্ধি করবেন যে আসলে তাঁর যতটা জানার কথা সে তুলনায় তিনি কিছুই জানেন না। তাই তিনি নিজেকে মূর্খ্য ভাবতে শুরু করবেন।
ধর্ম শব্দের অর্থ ধারন করা; মনের গভীরে ধারন করা। এটা অবশ্যই দেখিয়ে বেড়ানোর জিনিস নয়। যার যার ধর্ম তাঁর তাঁর কাছে। আমার আপনার কখনোই উচিত হবে না কারো স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা। আমি আপনার ধর্মের না-ই হতে পারি, আমি হতে পারি নাস্তিক- তাই বলে আমার কখনোই আপনার ধর্মকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। হোক সেটা মুখের কথায়, কার্যকলাপে কিংবা আমার লিখায়। যদি আমি সেটা করে থাকি তাহলে আপনি ধরে নেবেন আমি সবেমাত্র জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশ করেছি। আমার জানার বাকী বলতে গেলে পুরোটাই।
আপনি যখন কোন ব্যাপারে মন্তব্য করবেন, যখন কোন কিছুর বিরুদ্ধে বলতে যাবেন তখন আপনার উচিত হবে বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে পড়াশোনা করে নেয়া। ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে কখনোই কোন কিছুর নিন্দা করতে নেই। যদি আপনি সেটা করে থাকেন তবে নিশ্চিতভাবেই আপনি জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশ করেছেন। প্রকৃত অর্থে মূর্খ্য বলতে যা বোঝায় সেটা আমি-আপনি দুজনেই।
এই জগত সংসারে আমরা যা কিছু করি তার প্রধান দুই তিনটি উদ্দেশ্যের অন্যতম হচ্ছে খ্যাতি লাভ করা। আমরা সবাই চাই বিখ্যাত হতে। শত-সহস্র-কোটি মানুষের মাঝে আমি আপনি সবাই চাই লোকজন আমাকে বা আপনাকে অন্যভাবে চিনুক, অন্যভাবে জানুক। সেজন্য আমরা নানান পন্থা অবলম্বন করি। অনেকের মাঝেই এক ধরনের প্রবনতা দেখা যায় সেটা হচ্ছে প্রচলিত নীতি বহির্ভূত কথা বার্তা বলে বা লিখে সবার মনোযোগ আকর্ষন করা। এর মধ্যে ধর্মকে কটাক্ষ করা অন্যতম। এটা করে খুব সহজভাবেই আলোচনায় আসা যায়। যদিও এই টেকনিকটা এখন বেশ সেকেলে আর সস্তা হয়ে গেছে। কথা যেটা সেটা হচ্ছে, যারা এমনটা করে থাকে তারা নিঃসন্দেহে জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশ করেছে। তাঁর আরো অনেক জানতে হবে, পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে জ্ঞানের পরবর্তী উচ্চতর স্তরে প্রবেশের জন্য।
আপনার কখনোই উচিত হবে না এটা ভাবা যে আপনার সব জানা হয়ে গেছে। আপনি পা এর উপর পা তুলে রিক্সায় করে যাচ্ছেন, যে লোক মাথায় গামছা বেধেঁ রিক্সাটা চালাচ্ছেন তাঁর কাছ থেকেও আপনার অনেক কিছু জানার থাকতে পারে। আপনি যেসব ব্যাপারে ভালো বোঝেন সে হয়তো এসব বুঝবে না কিন্তু সেও এমন কিছু ব্যাপার জানে বা বোঝে যেসব আবার আপনি বোঝেন না। সুতরাং কারো জ্ঞানকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারন নেই। চেষ্টা করতে হবে সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু নেয়ার, কিছু না কিছু শেখার। কথায় আছে- আমাদের চোখ দুইটা, কান দুইটা কিন্তু মুখ একটা কেন? কারন দেখতে হবে বেশি, শুনতে হবে বেশি আর বলতে হবে কম। তাইতো আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন- “আমি শুনতে ভালোবাসি; শুনতে শুনতে অনেক কিছু অর্জন করেছি। অধিকাংশ মানুষই শুনতে আগ্রহী নন।”