প্রথমেই যে বর্ণনা দেব সেটির সময়কাল ফেব্রুয়ারী ১, ২০১৫। বর্ণনার মূল চরিত্র নুরুজ্জামান কবে কোথায় জন্মেছেন সেটা আমাদের জানা নেই। নুরুজ্জামানের বেড়ে ওঠা কোথায় সেটিও আমরা জানিনা। আমরা জানি ঘটনার ঠিক মাঝপথ থেকে। যেখানে একজন দর্শক হিসেবে আমরা জানতে পারলাম নুরুজ্জামান ব্যবসার কাজে চট্রগ্রাম যাবেন। নুরুজ্জামানের দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে মাইশা তাসনিম বায়না ধরেছেন বাবার সাথে তিনিও চট্রগ্রাম যাবেন। চট্রগ্রামের কাছেই তো কক্সবাজার। সুতরাং বাবা যখন চট্রগ্রামে যাবেনই তখন কক্সবাজারটাও এ যাত্রা ঘুরে দেখবার একটা সুযোগ থাকে। বাবাকে এই কথা বলতেই তিনি মেয়ের এই বায়না ফেলেন নি। মেয়ের বায়না মেটাতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তাহলে পরিবারের সবাইকে নিয়েই এই যাত্রা কক্সবাজার দেখে আসা যাক। সুতরাং তিনি সাথে নিলেন প্রিয় কন্যা, পূত্র আর স্ত্রী মিতা মাহফুজাকে। কক্সবাজারে স্ত্রী, পূত্র আর মেয়েকে নিয়ে ঘুরেছেন নুরুজ্জামান। জীবনের আনন্দের সময়গুলো পার করেছেন পুরো পরিবারকে নিয়ে।
এইসব উষ্ণ স্মৃতি সাথে করে নুরুজ্জামান ঢাকায় ফিরছিলেন আইকন পরিবহনের একটি বাসে। নুরুজ্জামান প্রিয় কন্যাকে পাশে নিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। কুমিল্লার কাছাকাছি ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের জগমোহনপুর এলাকায় রাত তিনটার দিকে একটি “গণতান্ত্রিক” পেট্রোলবোমা এসে পড়ে আইকন পরিবহনের সেই বাসে। নুরুজ্জামানের স্ত্রী ও পূত্র আগুন লাগবার পর বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন। বেঁচে যান তাঁরা। নুরুজ্জামান আর তাঁর কন্যা মাইশা জীবনের শেষ ঘুম থেকে আর উঠতে পারেন নি কিংবা হয়ত উঠেছেন কিন্তু এই জ্বলজ্বলে হলুদ আগুনের থেকে আর তাঁরা দু’জন ফিরে আসেন নি।
এই লেখাটির ঠিক এই সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে আমরা বলব আরো একজন নুরুজ্জামানের কথা। এই বর্ণনার সময়কাল ৬-জানুয়ারী ২০১৪। আমাদের এই অংশের বলা বর্ণনার নুরুজ্জামানের ক্ষেত্রেও আমাদের জানা নেই তিনি কবে কোথায় জন্মেছেন কিংবা কোথায় বেড়ে উঠেছেন। আমরা জানি নুরুজ্জামানের ছিলো স্ত্রী রত্না, দুই বছরের মেয়ে সাহা ও চার বছরের পূত্র সাহেল। নুরুজ্জামান পেশায় ট্রাক চালক। তাঁর আরো চার ভাই রয়েছেন। সব ভাই মিলে একটি ট্রাক কিনেছেন আর সেই ট্রাক নিয়েই নুরুজ্জামান গরু বোঝাই ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছিলেন নরসিংদী। গাজীপুরের মৌচাকে আসতেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে এই ট্রাকের দিকে সেই একই “গণতান্ত্রিক” পেট্রোল বোমা ছুটে আসে। আগুনের বিভৎস হলকা নুরুজ্জামানকে সাথে করে নিয়ে চলে যায় ঠিক তার একদিন পরের খুব সকালে।
এই ঘটনা দুইটির সময়ের পার্থক্য এক বছর। দু’জন নুরুজ্জামানকেই বিনা অপরাধে খুন করা হয়েছে এই তাঁদেরই বাংলাদেশে। গত ৫-ই জানুয়ারী ২০১৪ থেকে আজ ৪ ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫ পর্যন্ত এমন প্রায় অসংখ্য মানুষের আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে এইভাবে খুন হবার। আর খুন হয়েই এসব ঘটনাগুলো মূলতঃ শেষ হয়ে যায়না। কাগজে কলমে মৃত নয় কিন্তু আত্নিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবে ভেঙ্গেচুরে খান খান করে দিয়ে যায় নুরুজ্জামানদের পুরো পরিবার। বিধবা স্ত্রী তাঁদের অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানদের নিয়ে এই বাংলাদেশে তাঁদের জীবন শুরু করেন। আজকে যারা এই লেখা পড়ছেন আর ইচ্ছে করছেনা তাঁদের জন্য কাব্যিক ভাবে নতুন করে এই মৃত্যু পরবর্তী বুকভাঙ্গা উপখ্যানের বর্ণনা করতে।
বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলি কনা আর বাস্তবতার গলি ঘুপচি আপনাদের চেনা। দয়া করে কল্পনা করে নিন আমাদের দুই ঘটনার দুই বিধবা স্ত্রী মিতা মাহাফুজা আর রত্না এবং তাঁদের বেঁচে থাকা বাকি সন্তান সন্তদিদের কথা। যদি সেই ঘটনাগুলো অনুধাবন করে আপনি আঘাতপ্রাপ্ত হন, আপনি কষ্টের নীলে ভেসে যান প্রবল বিষাদে ও যন্ত্রণায় তবে উপযাচক হয়ে আমি আগেই ক্ষমা চাই।
সারা বাংলাদেশটাকে এখন পরিণত করা হচ্ছে একটা জলজ্যান্ত মৃত্যু উপত্যাকায়। এই চেষ্টা করবার যাত্রায় শেখ হাসিনা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা আর তার সাথে হাত মিলিয়েছেন মহাজোটের আরো কর্মীরা। হাসিনা আর তার প্রিয় দূর্নীতিবাজ কর্মীদের ছুঁড়ে দেয়া এই সম্মিলিত এবং সর্ব সম্মতিক্রমে অন্তঃর্দলীয় অনুমতি প্রাপ্ত এই ধরনের পেট্রোলবোমাকে নির্দ্বিধায় “গণতান্ত্রিক” বলা যেতে পারে। যদিও তারা এইসব পেট্রোল বোমাকে প্রচার করে থাকেন বি এন পি’র কাজ বলে কিংবা কখনো জামাত শিবিরের কাজ হিসেবে। আমাদের দু’টি বর্ণনার দু’জন নুরুজ্জামান সেক্ষেত্রে “গণতান্ত্রিক অস্ত্রের আঘাতে গণতান্ত্রিক সরকার পুনোরোদ্ধার যুদ্ধে (!!) নিহত”, এমন বললে সেটি হয়ত হাসিনা এবং তাঁর সভাসদ দের কাছে মোটেই অতিরঞ্জিত কোনো স্টেটমেন্ট হয়ে উঠবে না।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত, চলবে