বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ৬৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এস্কান্দার মজুমদারের আদিনিবাস ফেনী জেলায় হলেও পরবর্তীতে তারা দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯৬০ সালে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করেন। ১৯৬০ সালেই কলেজপড়ুয়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমানের বিবাহ হয়। ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম পুত্র তারেক রহমানের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকো জন্ম নেয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বেগম খালেদা জিয়া দুই সন্তানসহ গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার সংহতি ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে শহীদ হন।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত, আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। বিগত কিছুকাল যাবৎ আমি বিএনপির কার্যক্রম গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। দলের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হতে পারে, এমন মনে করে আমাকে দলের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তাই দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিতে যোগ দিয়েছি ও দলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং শহীদ জিয়ার গড়া দলে ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া আমার লক্ষ্য।’
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতার জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে নামেন বেগম খালেদা জিয়া। রাজপথের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর অকুতোভয়, সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বেগম জিয়া গণতন্ত্রের পতাকা সমুন্নত রাখতে আপসহীন ভূমিকা নেন। দীর্ঘ নয় বছর তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। তার আপসহীন নেতৃত্ব স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সূর্যকে নতুনভাবে উদিত করে। স্বৈরশাসনবিরোধী আপসহীন ভূমিকার জন্য সে সময় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম তাকে ‘মোস্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার অব দ্য ইস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। দেশের জনগণ তাকে অভিহিত করে দেশনেত্রী অভিধায়।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে দেশের মানুষ তার নেতৃত্বে রাজপথে নেমে আসে। ফলে এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ফিরে আসে গণতন্ত্র। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীর পানি প্রাপ্তিতে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বেগম খালেদা জিয়া জাতিসংঘের অধিবেশনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবি উত্থাপন করেছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে গণতন্ত্র ও দেশের উন্নয়নে ছায়া সরকার হয়ে কাজ করেছেন।
২০০১ সালে জনগণের ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে আবারো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার পান বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমন, শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে বিএনপি সরকার।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তান্ডবে বিপর্যস্ত হয় গণতন্ত্র। আওয়ামী লীগসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলের সমর্থন-সহযোগিতায় জারি হয় জরুরি অবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকার। এ সময় গণতন্ত্র ধ্বংসের মুখে দাঁড়ায়। আবারো আপসহীন ভূমিকায় নামেন বেগম খালেদা জিয়া। সব ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। জরুরি সরকার তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে চাইলেও ‘মরতে হলে এ দেশেই মরবো’ বলে তিনি দেশত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। যার ফলে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় তাকে কারান্তরীণ করা হয়। একই কায়দায় তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান ও কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমানকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কারাগারে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তারেক রহমানের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে দেয়া হয়।
২০০৮ সালের একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ক্ষমতাসীন হয়েই তারা দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্যে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির ওপর জুলুম-নির্যাতন চারাতে শুরু করে। আবারো বেগম খালেদা জিয়া জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম বর্তমানে চলছে, বেগম খালেদা জিয়া তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টি বিচক্ষণতা নিয়ে। অতীতেও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও অন্যায় দাবির মুখে মাথানত না করার ঐতিহ্য রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। নিজের কর্তব্য থেকে একচুল সরে না আসা, দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা তাকে দুঃসময়ের কান্ডারী হয়ে ১৬ কোটি মানুষকে সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে শক্তি জুগিয়েছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে রুখে দিয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে বেগম খালেদা জিয়া জনগণকে পুনরায় এনে দেবেন আলোকিত দিন- এ বিশ্বাস এ দেশের প্রতিটি মানুষের।