বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যায় এখন এই দেশটা যেন এক ভয়ের এক নির্মম স্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।প্রতি মাস কিংবা একটা সুনির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে দিয়ে বর্বরভাবে চাপাতি দিয়ে ব্লগার হত্যা করা হলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে নেই কোনো ভ্রক্ষেপ, নেই কোনো বিচারের চেষ্টা। দিনে দিনে যেন এই জনপদ অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণ আন্দোলন চলবার সময়ে রাজীব হায়দারকে হত্যা কান্ড দিয়ে খুনের শুরু আর তারও প্রায় মাস খানেক আগে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে কুপিয়ে জখম সে সব কিছুই ছিলো এই হত্যা উৎসবের প্রাথমিক শুরু।
যদিও ৭০ দশকে এই ধর্মবেত্তাদের ভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো কবি দাউদ হায়দারকে এবং ৯০ দশকে দেশ ছাড়তে হয়েছিলো সব্যসাচী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে বাংলা একাডেমী বইমেলার সামনেই নৃশংস ভাবে কোপায় জঙ্গীরা। কিন্তু সেসব ঘটনার এত দিন সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরেও অপরাধীদের গ্রেফতারে সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোনো আন্তরিকতা।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে কতজন অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়েছে বা ধরা হয়েছে তাহলে উত্তরে যা আসবে তা অত্যন্ত লজ্জার। এইতো কিছুদিন আগে আওয়ামী বুদ্ধিজীবি আনোয়ার হোসেনের এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের পিতা অজয় রায় অভিযোগ করে বলেছেন যে তাকে নাকি অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে যে অভিজিতের অপরাধীরা শনাক্ত হয়েছে, এখন ধরা হবে, তখন ধরা হবে ইত্যাদি। কিন্তু গত সপ্তাহে পুলিশের আইজি শহীদুল ইসলাম বলেছেন যে অভিজিৎ ও দীপনের হত্যাকারীরা পালিয়ে গেছে।
রাজীব হায়দার হত্যার পর পর ২০১৫ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী বাংলা একাডেমীর বই মেলাতে খুন হন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক অভিজিৎ রায়। তারও এক মাসের মধ্যে ৩০ শে মার্চ খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু তার নিজের বাসার সামনে। এরপর ২০১৫ সালের ১২ ই মে সিলেটে খুন হন ব্লগার ও লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। অনন্ত নিজ বাসা থেকে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন।
এরপর ৭ আগষ্ট ২০১৫ প্রকাশ্য দিবালোকে ভাড়াটিয়া পরিচয়ে বাসায় ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার আসল নাম নীলাদ্রি চক্রবর্তী (৪০) আগের মতোই এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম।
এই ঘটনার পর পর ৩১শে অক্টোবর ২০১৫ সালে জঙ্গীরা দুই ভাগের আক্রমনে হত্যা করে অভিজিৎ রায়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে এবং হত্যার উদ্দেশ্যে গিয়ে কোপায় আহমেদুর রশীদ টুটুল, তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে।
প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর তিন জনের ওপর হামলার ঘটনার কোনো কূলকিনারা হয়নি। এই দুই ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব মূল আসামি দূরে থাক, সন্দেহভাজন কাউকেও আটক করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলায় আহত প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল ও ব্লগার তারেক রহিম কয়েকদিন আগে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। আহত রণদীপম বসুও দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
খুনীরা খুন করবার আগে বিভিন্ন ভাবে ফেসবুক পেইজ, ব্লগ ও তাদের ওয়েবসাইটেও এই ব্লগারদের হত্যার হুমকি দিয়েছিলো কিন্তু আওয়ামী প্রশাসন এইসব হুমকি কে পাত্তা না দিয়ে বরং এটাই প্রমাণে ব্যস্ত ছিলো যে এই হত্যাকান্ড করেছে বি এন পি ও জামায়াত। ক্রমাগতভাবে বিরোধী দলকে দমন করবার অপঃকৌশল হিসেবে আওয়ামীলীগ সরকারই এইসব হত্যাকান্ডকে পেট্রোনাইজ করেছে বলে অনেক অভিজ্ঞ মহল দাবী করেছে। ২০১৫ সালের অগাস্টে “ইত্তেহাদুল মুজাহেদীন” নামের একটি অজানা সংগঠন ১৯ জন লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবিদের নাম দিয়ে হুমকি পাঠায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। সেখানে লেখক আব্দুল গাফফার, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনি, লেখক মুহাম্মদ আব্দুর রহমান, ইমরান এইচ সরকার, ইমি রহমান পিয়াল সহ অনেক ব্যাক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়। কিন্তু সেই হুমকির ব্যাপারে এই পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।এই হুমকিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে লন্ডনে বসবাসকারী লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যাপারটি অত্যন্ত সেনসিটিভ এই রকম মন্তব্য করে আমাকে কোনো রকম মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আরেকজন লেখক ও ব্লগার মুহাম্মদ আব্দুর রহমানকে এই হুমকি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তাঁর অভিমত ব্যাক্ত করেন। তিনি বলেন যে, “বাংলাদেশ এখন এক রক্তাক্ত জনপদ। এখানে কারও নিরাপত্তা নেই। আমার বিরুদ্ধে তো মামলা দেয়া হয়ছে ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত কতবার অপরাধে সেই ২০০৯ সাল থেকেই। আমাকে পেলে তারা হত্যা করতে দিবার ভাববে না আর এসব নিয়ে ভাবলে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারব না কখনইে”
এই ব্যাপারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অবসর প্রাপ্ত লেঃ কর্ণেল হায়দার রহমানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যে এইভাবে একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক খুন হচ্ছে আর সরকারের আইন রক্ষাকারী বাহিনী তা ধরতে পারছে না এটা বিশ্বাযোগ্য নয়। তিনি আমার সাথে টেলিফোন আলাপে বলেন যে, সরকারের ভেতরের একটি অংশ এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। তিনি আরও বলেন যে, “সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজত ইসলাম নামে একটি ইসলামী সংগঠন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে সরকার তাদের বিভিন্নভাবে দমন করবার চেষ্টা চালায় ও সেই দল সরকার বিরোধী নানাবিধ প্রচার চালায়। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন যে এই দলটি এখন সরকারের পক্ষেই কথা বলছে। আপনারা মনে করে দেখবেন যে এই দলের প্রধান মাওলানা আহমেদ শফী যেদিন থেকে বলেছিলেন যে ব্লগারদের মারা ওয়াজিব হয়ে গেছে সেদিন থেকেই এই ব্লগার ও লেখক হত্যা আরো জোরে শোরে শুরু হয়েছে”
বিজ্ঞ এই বিশেষজ্ঞের মতামতের পর মূলত এটিই ধারনা করা যায় যে বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল অবস্থায় নেবার জন্য এবং যাতে ভারতের আইন রক্ষাকারী বাহিনী যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই সরকার এই ব্লগার ও লেখক হত্যাকান্ড করছে। যেখানে শেখ হাসিনাকে নিয়ে দুই শব্দ লিখলে ফেসবুক থেকে খুঁজে বের করা হয় কিংবা নাম ধরে না লিখলেও যেখানে বুয়েটের একজন শিক্ষকের ৬ মাসের জেল জরিমানা হয় সেখানে ব্লগার হত্যাকান্ডে জড়িতদের সরকার ধরতে পারেনা এটা একেবারেই বিশ্বাযোগ্য নয়।
সরকার থেকেই বার বার বলা হচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশকে জঙ্গী নির্মূলে সাহায্য করবে। তাহলে এইভাবে জঙ্গী তৈরী করে ভারতের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ঢুকাবার ইচ্ছাতেই কি এই জাতীয় হত্যাকান্ড ঘটানো হচ্ছে কিনা এটাই এখন বড় প্রশ্ন। সরকারী ব্যার্থতা, অবহেলা, চরম দূর্নীতির কারনে পুলিশ বা আইন রক্ষাকারী বাহিনীর উপরে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা যে তলানীতে ঠেকেছে সেটার বড় প্রমান হচ্ছে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের পিতা নিজেই মিডিয়ার সামনে বলেছেন যে তিনি তাঁর পূত্র হত্যার বিচারই চান না কারন এই সরকার বিচার করবার জন্য যোগ্য না বা পারবে না। একই মতামত ব্যাক্ত করেছেন অভিজিৎ রায়ের পিতা ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অজয় রায়।
একটা দেশের আইন, শৃংখলার অবদমন হলে মানুষ এইভাবে ভাবতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।