প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা এবং শুভঙ্করের ফাঁকি :
১/ মোট অর্থ প্রণোদনা বাংলাদেশের জিডিপির ৩.৩’শতাংশ অর্থাৎ ৯৫,৬১৯’কোটি টাকা।
২/ স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য প্রণোদনা-
ক) ৫’লাখ মেট্রিক টন চাল
খ) ১’লাখ মেট্টিক টন গম
গ) ১০’টাকা কেজি হিসেবে ৭৪’হাজার মেট্রিক টন চাল।
অর্থাৎ চাল এবং গম মিলিয়ে মোট ৬’লাখ ৭৪’হাজার মেট্রিক টন খাদ্য প্রণোদনা।
৩/ বিশ্বব্যাংকের হিসেবে মধ্যআয়ের দেশে যারা দৈনিক ৩.২ ডলারের নীচে আয় করে তারাই দরিদ্র অর্থাৎ স্বল্প আয়ের মানুষ। বাংলাদেশে এরকম মানুষের সংখ্যা ৮’কোটি ৬২’লাখ। প্রণোদনার মোট ৬’লাখ ৭৪’হাজার মেট্টিক টন খাদ্য এই ৮’কোটি ৬২’লাখ মানুষের ক’দিন যাবে?
ক) বাংলাদেশে প্রায় ১৮’কোটি মানুষের বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা ২’কোটি ৯১’লাখ মেট্রিক টন।
খ) ঐ হিসেবে ৬’লাখ ৭৪’হাজার মেট্রিক টন খাদ্যে ৮’কোটি ৬২’লাখ মানুষের টেনেটুনে ২’সপ্তাহ চলতে পারে। ওখানে আবার ৭৪’হাজার মেট্রিক টন চাল দরিদ্রদের ১০’টাকা কেজি ধরে কিনে নিতে হবে। এরপর কি লকডাউন উঠে যাবে? কাজকর্ম শুরু হবে? যেভাবে চলছে অন্তত আগামী দু’মাস অবস্থা স্বাভাবিক হবে মনে হচ্ছে না। যদি তা হয়, দু’সপ্তাহ পরে এই ৮’কোটি ৬২’লাখ মানুষ কি খেয়ে বেঁচে থাকবে?
৪/ এবার আমরা দৃষ্টি দেয় অর্থ প্রণোদনার দিকে, মূলত এর সিংহভাগ দেয়া হয়েছে শিল্পখাত, গার্মেন্টস এবং ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে প্রণোদনা হিসেবে, দরিদ্র এবং কৃষিখাতে দেয়া হয়েছে খুব অল্প। বরাদ্দ দেয়া নিম্নরূপভাবে—
ক) ৯৫’হাজার ৬১৯’কোটি টাকার প্রণোদনায় ৮৬’হাজার ৯০’কোটি পাবে শিল্প, গার্মেন্টস এবং ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে লোন হিসেবে। এর সুদের হার ২%। যা মোট প্রণোদনার ৯০%।
খ) বাকি ৯’হাজার ৫২৯’কোটি টাকার ৪’হাজার ৫২৯’কোটি টাকা দিয়ে দরিদ্র আয়ের মানুষদের বিভিন্ন ভাবে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে, বাদ বাকি ৫’হাজার কোটি টাকা কৃষকদের লোন হিসেবে দেয়া হবে। যার সুদের হার ৪%। মোট প্রণোদনার ১০% এর পরিমাণ।
৫/ করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার ভারত এবং পাকিস্তানে ব্যতিক্রমী প্রণোদনা——
ক) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৮’কোটি দরিদ্র মানুষের জন্য ৬’মাসের চাল বরাদ্দ করেছে।
খ) পাকিস্তান সরকার ১’কোটি ২০’লাখ দরিদ্র পরিবারের প্রায় ১০’কোটি মানুষের জন্য, পরিবার প্রতি মাসিক ১২’হাজার টাকা করে বরাদ্দ করেছে। ঐ বরাদ্দ এরেই মধ্যে দেয়া শুরু হয়েছে, যা চার মাস পর্যন্ত দেয়া হবে।
৬/ করোনাভাইরাস মহামারীর বিপদ থেকে জনগণকে উদ্ধারে বর্তমান সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে তাকে আমরা নিম্নোক্তভাবে পর্যালোচনা করতে পারি —–
ক) আমাদের স্বল্প আয়ের মানুষের সংখ্যার তুলনায় সরকারের খাদ্য প্রণোদনা নিতান্তই কম। যা নিয়ে মাত্র দু’সপ্তাহ চলতে পারে। এমনকি এই সাহায্য আমাদের চেয়ে উন্নতিতে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের দেয়া প্রণোদনার তুলনায় অনেক নগণ্য।
খ) সরকারের প্রণোদনার অর্থের ৯০% পেয়েছে শিল্পখাত, গার্মেন্টস, ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ তেলের মাথায় তেলই দিচ্ছে সরকার। আর গরীব ও কৃষকরা পেয়েছে মাত্র ১০%। আবার ব্যবসায়ীদের সুদ দিতে হবে ২%, অথচ কৃষকদের দিতে হবে ৪%।
গ) এতো গেলো বরাদ্দের ব্যাপার। বিলিবন্টনে আমরা গত ২/৩ সপ্তাহ ধরে দেশে চরম মিডিয়া সেন্সরশিপের মধ্যেও চাল চোরের যে চিত্র দেখছি তা যেকোনো সুস্থ মানুষের অসুস্থ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। মৃত্যু ভয়েও ভীত নয় এই চোররা। করোনাভাইরাসের চেয়ে এখন চাল চোররা ভয়ানক বেশী। তাছাড়া দেশে আবিষ্কৃত করোনা রোগীকে সংখ্যায় এরই মধ্যে চাউল চোররা অতিক্রম করে গেছে।
ঘ) জোরজবরদস্তি এবং রাতের আঁধারে কূট কৌশলে নির্বাচিত হওয়ার কারণে জনগণের ভোটের প্রয়োজন এসরকারের হয়নি। তাই অধিকাংশ জনগণের দুঃখ ধারণ করতেও সক্ষম হয়নি এই সরকার। তাই তো প্রণোদনাতেও তারা জনবান্ধব হতে পারেনি।
ঙ) করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দৈন্যদশা ফুটে উঠছে। অথচ সেই খাতেও বরাদ্দ নেই এই প্রণোদনায়।
চ) উন্নত বিশ্বের কথা বাদই দিলাম পাশ্ববর্তী যে দেশগুলো নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিষ্ট শাসক গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত ঠাট্টা মশকরা করে, তাদের প্রণোদনারও কাছাকাছি না সরকারের দেয়া প্রণোদনা। অথচ প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের কথাবার্তায় বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে সুইজারল্যান্ড, ডালাস পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে অনেক আগে। তাই আবারও প্রমাণিত হলো এ সরকার জনবান্ধব নয়, আত্মবান্ধব সরকার, এই সরকারের সব প্রণোদনাই নিজেদের লাভের জন্য- এমনকি জাতির এই চরম দূর্দিনেও।
শাকিলা ফারজানা, লেখক ও রাজনিতিক।