সরকারের দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম সত্ত্বেও নতুন দিনের আশায় বিএনপি। দলটি এখন কেবল পদে পদে মারই খাচ্ছে না, ষড়যন্ত্রের একটি গভীর বলয়ের মধ্যেও নিপতিত। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত চলছে বহু দিন ধরেই। চেইন অব কমান্ড ভেঙে দিতে সক্রিয় নানামুখী তৎপরতা। এমন এক প্রেক্ষাপটে হতাশার মধ্যে আশার আলো খুঁজছেন নেতাকর্মীরা। নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যেও বন্ধন অটুট রেখে চলছে দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলটি।
মামলায় বিপর্যস্ত দলটির তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ কেন্দ্রীয় ১৫৮ জন নেতার বিরুদ্ধে চার হাজার ৩৩১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা এখন বিএনপির জন্য উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটির আশঙ্কা, এসব মামলায় সাজা দিয়ে শীর্ষস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযোগ্য করা হতে পারে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে পুরনো মামলায় চার্জশিট এবং নতুন মামলা দেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২১ হাজার ৬৮০টি মামলা হয়েছে। এতে আসামির সংখ্যা চার লাখ ৩ হাজার ৮৭৮ জন। এর মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্যের বিরুদ্ধেই আছে ২৮৮টি মামলা। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি, দলের ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে আছে ৭০টি, সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ১০১টি মামলা। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ১৩০টি মামলা হয়েছে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, চার সিটি করপোরেশনে বিএনপির নির্বাচিত মেয়রদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে ৩৮টি। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন ১৩টি, গাজীপুরের মেয়র আব্দুুল মান্নান ১১, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ৯টি ও বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামাল ৫টি মামলার আসামি। এসব মেয়রকে বরখাস্ত করেছে সরকার। কারাগারে আছেন বেশ কয়েকজন।
সারা দেশে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন ৩০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। নতুন করে গ্রেফতার অভিযান শুরু হওয়ায় এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই গ্রেফতার অভিযান এমন সময় চলছে, যখন বিএনপির কোনো কর্মসূচিই নেই। সারা দেশে চলছে তাদের দল গোছানোর কার্যক্রম। এ কার্যক্রমকে সামনে রেখে মামলা-হামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল এক ধরনের চাঞ্চল্য। চলতি বছরের শুরুতে আন্দোলন চলাকালীন গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীরাও জেল থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে নতুন করে গ্রেফতার অভিযান শুরু হওয়ায় বিরোধী নেতাকর্মীদের সাময়িক চাঞ্চল্য আবার উবে গেছে। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাদের। অনেক নেতাকর্মী বাড়িঘরছাড়া হয়ে পড়ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দুই বিদেশী হত্যা, ব্লগারদের ওপর আক্রমণ, পুলিশ হত্যাসহ বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনায় রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতার মাত্রা ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বেশি। সরকারের তরফ থেকে এসব ঘটনার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দুই বিদেশী হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বিএনপির দুই নেতার দুই ভাইকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এসব ঘটনায় ঠিক কারা কিভাবে জড়িত হামলাকারীদের উদ্দেশ্যই বা কী সে সম্পর্কে সরকার কিংবা পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ভীষণ চাপে পড়েছে ক্ষমতাসীনেরা। একটির পর একটি দুর্ঘটনা ঘটতে থাকায়, এ চাপ ক্রমশই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মহল সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোয় সৃষ্টি হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতি।
এসব হত্যাকাণ্ডকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের ধরপাকড়ের আড়ালে সরকারের ভিন্ন উদ্দেশ্যও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে পৌরসভা নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের চাপের মুখে রাখা। যাতে বিরোধী দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না পারেন। এর মাধ্যমে পৌরসভাগুলোর নিয়ন্ত্রণ যাতে ক্ষমতাসীনদের হাতে চলে আসে। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিকে ঘিরে কোনো কর্মসূচি সফল হতে না পারে সে পরিকল্পনাও ধরপাকড়ের অন্যতম কারণ। সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে, নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে বিএনপি জোট আবারো মাঠে নামতে পারে। দেশজুড়ে দেয়া হতে পারে কর্মসূচি। সেই কর্মসূচি যাতে কোনোভাবেই সফল হতে না পারে, সেজন্য দুই মাস আগে থেকেই সরকার সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
মামলা-হামলা, জেল-জুলুমে জর্জরিত তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশাও দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রের দুর্বল নেতৃত্ব তাদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। আন্দোলন কর্মসূচিতে সমন্বয় না থাকায় দিনের পর দিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দল ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যা নেতাকর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন আনা হবে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের আসীন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ ক্ষেত্রে ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারির মধ্যে একটি কাউন্সিল করার উদ্যোগ নেয়া হবে, যা হবে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল। এর মধ্য দিয়ে দল পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবসহ বেশ কিছু নতুন নেতৃত্ব সামনে চলে আসবে। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই হবেন বিএনপির মহাসচিব। দীর্ঘ চার বছর ধরে মির্জা ফখরুল ভারপ্রাপ্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
খালেদা জিয়া বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। চিকিৎসার জন্য তিনি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সেখানে যান। নভেম্বরের শেষের দিকে দেশে ফিরতে পারেন তিনি। দলটির নেতারা বলছেন, সাংগঠনিকভাবে বিএনপি চেয়ারপারসনের লন্ডন সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনে তিনি বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে দল পুনর্গঠন নিয়ে কথা বলেছেন।
দলের চেয়ারপারসনকে তারেক রহমান জানিয়েছেন, তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবারো কীভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায় তা নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তারেক রহমান। আলোচনার ফর হিসেবে দলের মহাসচিব নির্বাচন, স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আনা, নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে সাচ্চা নেতাদের পদায়নের বিষয়গুলোতে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বেগম জিয়া। দেশে ফিরে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন তিনি। দলের নেতাকর্মীদের আশা ক্ষমতাসীনদের নানা প্রচেষ্টার মধ্যেও দলের মধ্যে ঐক্য অটুট আছে। দল ভাঙার জন্য বিশেষ মহল নানা চেষ্টা করলেও তাতে সফল হয়নি। বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন চললেও সরকার এখন নানা ধরনের সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের ঐক্য অটুট রাখতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপি আবার ঘুড়ে দাঁড়াবে।