নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত হয়ে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করবেন, এমন প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হচ্ছে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে যেসব নির্বাচন উপহার দিয়েছে, তাতে এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই ক্ষমতাসীনদের দলীয় আকাক্সক্ষা পূরণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিতর্কিত ও কলঙ্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন যেখানে ১৫৪ জন সংসদ সদস্যকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এই কমিশন থেকে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে এমন এক সংসদ প্রতিষ্টা করা হয় যার স্পিকার ভোট ছাড়া নির্বাচিত। বিরোধী দলের নেতারও ভোটের প্রয়োজন হয়নি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। জোর করে কাউকে সংসদ সদস্য বানানোর নজির বিশ্বের আর কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না।
এই নির্বাচন কমিশন উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে বেশির ভাগ উপজেলায় বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এর পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার চলে যান দীর্ঘ ছুটিতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে আর বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীদের খুঁজে পাওয়া গেল না। একচেটিয়াভাবে বাকি দুই ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে যান। ভোট ডাকাতির যত কৌশল আছে সব প্রয়োগ করা হয়। আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এমন নির্বাচনের পরও নির্বাচন কমিশনের বয়ান ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
এখন এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এই নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে থাকেন। ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত প্রার্থীরা অনেক আগেই নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাজধানী ছেয়ে গেছে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে; কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিশ্চুপ। এর মধ্যে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকেরা নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাৎ করে কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমা আরো কয়েক দিন বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। তারা আরো সুষ্টু নির্বাচনের জন্য আরো কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন যারমধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যারা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার পরিবেশ ও রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারকৃতদের নির্বাচনে অংশ নেয়া নিশ্চিত করা। তাদের সমর্থকদের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহনমুলক নির্বাচনের জন্য যেসব দাবি করা হয়েছে এগুলো নির্বাচন কমিশনের অনেকটা রুটিন কাজের অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এমন এক নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করছে যার এক চোখ সব সময় বন্ধ থাকে। এক দলের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলে মনে করে সবাই মাঠে আছে। ৫শতাংশ ভোটারও যদি ভোট না দিতে যায় তবুও তারা মনে করে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। একটি শূন্যের ব্যাপার আর কি! বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাতের পর নির্বাচন কমিশন যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাতে মনে হয় না এসব বক্তব্য কমিশন আমলে নিয়েছে।
এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগের নির্বাচনগুলোর মতোই সিটি করপোরেশন নির্বাচনও একতরফাভাবে আয়োজনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বরং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যাতে ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারেন তার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, পুলিশ ব্লকরেইড দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগে পুলিশের কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাত করে এপ্রিল মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শমতো নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচনের আয়োজনের মধ্যদিয়ে সরকার বিরোধী দলকে দমনের যে কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা বাস্তবায়ন হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিটি ওয়ার্ডে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তালিকা তৈরি করেছে। এদের অনেক পালিয়ে আছেন আবার কেউবা ভয়ে নীরব হয়ে আছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন তারা সরব হবেন তখন আরেক দফা নিবিড় গ্রেফতার অভিযান চলবে। নির্বাচনী কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।
কিন্তু এতে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। কারণ নির্বাচনের প্রচারণায় যখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মাঠে নামবেন, তারা আবারো নতুন করে গ্রেফতার ও হয়রানির মুখে পড়বেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। ফলে বিরোধী দলসমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে, এমন আশা করার সুযোগ নেই।
৫ জানুুয়ারির নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে কমিশন জনগণের যে আস্থা হারিয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও তা পুনরুদ্ধারের সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ কমিশন কাজে লাগাতে পারতো। কিন্তু তাদের সেদিকে আগ্রহ আছে এমন ভাবার কোনো কারন নেই। কারন এই নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীনদের একদলীয় শাসন কায়েমের একটি প্রাতিষ্টানিক উপকরন মাত্র।